দড়ি তো হলো, এবার বড়শি চাই। গাছের বাকা ডালের কথা ভাবল কিশোর। সাইজমত কেটে একমাখা চোখা করলে কি হবে? উঁহু। অন্য কিছু দরকার।
আগুন দেখে মাথার ওপর এসে কিচির মিচির শুরু করল বানরটা।
কিশোর, দুর্বল কণ্ঠে ডাকল মুসা। ইশারায় বানরটাকে দেখাল।
দূর, কি বলো? রবিন মাথা নাড়ল। সাপবিচ্ছু তো অনেকই খেলাম এই জঙ্গলে এসে। আর যাই বলো, বানর খেতে পারব না। মনে হবে মানুষ খাচ্ছি।
এই দৃষ্টিতে বানরটার দিকে তাকিয়ে আছে কিশোর। একেবারে মাথার ওপর, মাত্র কয়েক ফুট দূরে। হাত বাড়িয়ে ছোঁয়া যায় না অবশ্য। বাঁশ দিয়ে বানানো বল্লমটা তুলে নিল সন্তর্পণে। বানরটা কিছু বোঝার আগেই ধাঁই করে ছুঁড়ে মারল।
বল্লমে গেঁথে ধুপ করে পড়ল বানরটা।
খাবে তাহলে! রবিন বিশ্বাস করতে পারছে না।
কেন, অসুবিধে কি? হাসল কিশোর। অনেকেই তো খায়। ইনডিয়ানদের প্রিয় খাবার। আফ্রিকার পিগমিরা তো হরহামেশাই খায়। আর চীনারা কি করে জানো না?
এসব সবই জানে রবিন। আস্ত বানরশিশুর চামড়া ছিলে, দামী ডিশে করে টেবিলে দেয়া হয়। কাঁচা। চীনের কিছু অঞ্চলের মানুষের কাছে এটা খুব প্রিয়। খাবার। বিশেষ করে বানরের কাঁচা মগজ। দাম খুব বেশি বলে সাধারণ মানুষেরা খেতেই পারে না, যাদের পয়সা আছে তারাই কেবল পারে। মাথা নাড়ল সে, আমি খাব না। মরে গেলেও না। ওয়াক-গুহ! শেষমেষ বানরের মগজ!
কিন্তু খাওয়ার জন্যে মারেনি কিশোর। চামড়া ছুলে টুকরো টুকরো করে কাটল মাংস। হাড় দিয়ে চমৎকার কয়েকটা বড়শি হলো। ওগুলো পিয়াসাভার সরু দড়িতে বেঁধে, বাঁশ কেটে ছিপ বানাল। মাংসের একটা টুকরো গেথে বড়শি ফেলল। পানিতে। দেখা যাক, ভাগ্য কি বলে?
ফেলতে না ফেলতেই টান পড়ল ছিপে। পিরানহা নাকি? তাহলেও চলে। খেতে ভালই।
ছিপ তুলল কিশোর। বিশেষ জোর লাগল না। আরে, এ-কি! আস্ত এক ফুটবল! রবিনও অবাক।
ছুরির মাথা দিয়ে খোঁচা মারল কিশোর। ঠুস করে বেলুনের মত ফাটল ওটা। মাছটা ছোট, পেটটাকেই ফুলিয়ে এত বড় করেছে। বেলুন মাছ, বিড়বিড় করল সে। ছুঁড়ে ফেলে দিল পানিতে। এ-মাছ খাওয়া যায় না, বিষাক্ত
আবার ছিপ ফেলল।
এবার উঠল বেশ বড়সড় একটা পেইচি খাওয়া চলে, স্বাদ ভাল।
পেট ঠাণ্ডা হলো।
আর কোন কাজ নেই। আবার মাছ ধরতে বসল কিশোর আর রবিন।
আবার ছিপে টান পড়ল। বেশ জোর লাগল এবার তুলতে।
সাপ! চেঁচিয়ে উঠল রবিন। শরীর মোড়াচ্ছে প্রাণীটা।
বাইন, বলল কিশোর। খাওয়া যেতে পারে। বুঝতে পারল না ওটা কোন প্রজাতির। বড়শি থেকে খুলে নেয়ার জন্যে ধরতেই চিৎকার করে চোখ উল্টে পড়ল, বিকৃত হয়ে গেল চেহারা।
চোখ মেলে দেখল, রবিনের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে।
ইস, কি ভয়টাই পাইয়ে দিয়েছিলে, বলল উদ্বিগ্ন রবিন। কি হয়েছিল?
মুসাও হ্যামক থেকে মাথা বাড়িয়ে তাকিয়ে আছে।
জবার না দিয়ে কাত হয়ে বাইনটার দিকে তাকাল কিশোর। বড়শি ছুটে গেছে মুখ থেকে, ঘাসের ওপর দিয়ে এঁকেবেঁকে এগোচ্ছে রবিনের দিকে।
উঠে বসল সে। একটা লাঠির জন্যে তাকাল এদিক ওদিক।
রবিনেরও চোখ পড়ল বাইনটার ওপর।
না না, ছুঁয়ো না! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।
কিন্তু তার কথা শেষ হওয়ার আগেই সরানোর জন্যে ছুঁয়ে ফেলেছে রবিন। সঙ্গে সঙ্গে বিকট চিৎকার, তবে কিশোরের মত চোখ উল্টে পড়ল না। কারণ সে ছুঁয়েছে মাত্র, ধরেনি।
হাতের অবশ ভাবটা কাটল ধীরে ধীরে।
হলো কি তোমাদের? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল মুসা।
আস্ত জেনারেটর, ভয়ে ভয়ে বাইনটার দিকে তাকাল রবিন। কিলবিল করে এগিয়ে আসছে ওটা। লাফ দিয়ে সরে গেল সে। হাত ঝাড়ছে এখনও।
গর্ত খুঁড়তে শুরু করল কিশোর।
কি করছ? রবিন জিজ্ঞেস করল।
জবাব দিল না কিশোর। গর্ত খুঁড়ে তাতে পানি ভরে, একটা লাঠি দিয়ে ঠেলে নিয়ে গর্তে ফেলল বাইনটাকে। তারপর বলল, থাক।
কি হবে রেখে? জিজ্ঞেস করল মুসা। খাওয়া যাবে?
দেখা যাক। আর কোন ব্যবস্থা করতে না পারলে তো খাবই। বাইন মাছ। অখাদ্য নয়।
কিন্তু ওটাকে ধরলেই তো চিত হয়ে যাচ্ছ? কি আছে ওর গায়ে?
এখনও বুঝতে পারছ না? রবিন বলল। বিদ্যৎ। ওটা বিদ্যুৎ-বাইন।
ও। আচ্ছা, ইলেকট্রিক শক তো বাত সারায় শুনেছি। ম্যালেরিয়া সারায় না?
সারায়। চিরতরে, জবাব দিল কিশোর।
মানে?
এমন সারানো সারাবে, কোনদিন আর ম্যালেরিয়া হওয়ারই সুযোগ পাবে। না। সোজা পরপারে পাঠিয়ে দেবে তোমাকে।
কিশোরের রসিকতা বুঝতে পেরে একটা মুহূর্ত চুপ করে রইল মুসা। তারপর জিজ্ঞেস করল, কত ভোল্ট?
যে শক খেয়েছি, তিনশোর কম তো হবেই না।
যত বেশি বড় হয়, বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতাও নিশ্চয় তত বেশি?
না, মাথা নাড়ল কিশোর, সেটা নির্ভর করে কোন জাতের বাইন, তার ওপর। বিদ্যুৎ-বাইনেরও অনেক প্রজাতি। কোন কোনটার জেনারেটর সাংঘাতিক শক্তিশালী। মাত্র আড়াই ফুট লম্বা একটা বাইন ধরা পড়েছিল। পাঁচশো ভোল্ট বিদ্যুৎ তৈরি করতে পারত ওটা।
খাইছে! চমকে গেল মুসা। মানুষ মারা তো কিছুই না!
মানুষ কি, ঘোড়াও মেরে ফেলতে পারে। পানিতে নেমে গরুঘোড়া অনেক মারে। বাইন মাছ গায়ে লাগে, শক খেয়ে অবশ হয়ে যায় শরীর। তারপর ডুবে মরে।
কি মনে পড়ায় লাঠি দিয়ে আবার বাইনটাকে তোলার চেষ্টা করল কিশোর।
কি হলো? আবার তুলছ কেন? জিজ্ঞেস করল রবিন।