ক্ষুধায়, শীতে কাতর হয়ে হ্যামকে গিয়ে উঠল কিশোর।
গাছের ডালে বসে পাহারায় রইল রবিন। ভাসমান দ্বীপে কোন অজানা বিপদ লুকিয়ে আছে কে জানে। সাবধান থাকা উচিত। কয়েক ঘণ্টা পরে কিশোর এসে তার জায়গায় বসবে।
অন্ধকারে ছুটে চলেছে দ্বীপ। স্রোতের ওপর ভরসা এখন। সবচেয়ে বড় ভয়, নদীতে গজিয়ে থাকা আসল দ্বীপের সঙ্গে ধাক্কা লাগার। নিমেষে গুঁড়িয়ে যাবে। তাহলে এটা। কিন্তু স্রোতের গুণাবলী সম্পর্কে যতখানি জানে রবিন, কোন কিছুর সঙ্গে ধাক্কা খায় না, পাশ দিয়ে কেটে বেরিয়ে যায়! শুনেছে, এসব ভাসমান দ্বীপের সঙ্গে রাতে কানু বেধে আরামসে ঘুমায় ইনডিয়ানরা। সকালে উঠে দেখে নিরাপদে পেরিয়ে এসেছে তিরিশ-চল্লিশ মাইল।
হ্যাঁ, ভ্যাম্পের তুলনায় এই একটা সুবিধে তাদের রয়েছে। অন্ধকারে নৌকা। চালানোর সাহস করবে না ভ্যাম্প, কোথাও থামতেই হবে। কিন্তু ওরা চলবে। এগিয়ে যাবে অনেক পথ।
কখনও কখনও তীরের খুব কাছ দিয়ে যাচ্ছে দ্বীপ। বনের হাকডাক কানে। আসছে। একবার তো এত কাছে একটা জাগুয়ার গর্জে উঠল, রবিনের মনে হলো, ওটা দ্বীপেই উঠে এসেছে। এমনিতেই বিপদের কূল নেই, তার ওপর জাগুয়ার উঠে এলে..ধ্যাত্তোর! যা হয় হোকগে। ভাগ্যের ওপর কারও হাত নেই। এই যে, এই মন বিপদ পড়েছে, চব্বিশ ঘণ্টা আগেও কি ভাবতে পেরেছিল এমন ঘটবে?
মাঝরাতের দিকে কিশোরকে তুলে দিলু রবিন।
নিরাপদেই কাটল রাতটা। সকালে বানরটার চেঁচামেচিতে ঘুম ভাঙল রবিনের। ভোরের নিয়মিত প্রাত্যহিক কোলাহল জুড়েছে ওটা, সঙ্গীসাথী না পেয়ে একাই শুরু করেছে।
মুসার সঙ্গে কথা বলছে কিশোর।
খুশি হলো রবিন। মুসার শরীর তাহলে কিছুটা ভাল। নেমে এসে গায়ে হাত দিয়ে দেখল, জ্বর নেই।
মলিন হাসি হাসল মুসা।
পেটে আগুন জ্বলছে তিনজনেরই। তাড়াতাড়ি খাবারের ব্যবস্থা করা দরকার। বিশেষ করে মুসার জন্যে। এমনিতেই কাহিল, খাবার না পেলে আর মাথাই তুলতে পারবে না। হয়তো জরও ফিরে উঠবে আবার।
কিন্তু কি ব্যবস্থা করবে?
বিশুদ্ধ খাবার পানিও নেই। নদীর কাঁচা পানি খেলেই ধরবে টাইফয়েড কিংবা আমাশয়ে। ফুটিয়ে খেতে হবে। আগুন পাবে কোথায়? আর কেটলি? কোন পাত্রই তো নেই সঙ্গে।
কেটলির ব্যবস্থা করে ফেলল কিশোর। বাঁশ দিয়ে। একটা কচি বাঁশের গোড়ার দিকে একটা গাঁটের ঠিক নিচে থেকে কাটল। গাটের ওপরে আট ইঞ্চিমত রেখে বাকিটা কেটে ফেলে দিল। সারভাইভালের বইতে পড়েছে, কাঁচা বাঁশে পানি ফুটানো যায়, ভেতরে পানি ভরা থাকলে বাঁশ পোড়ে না।
কেটল তো হলো, এবার আগুন?
আগুন জ্বালানোর চেষ্টা চালাল কিশোর আর রবিন। হ্যামকে শুয়ে চেয়ে চেয়ে দেখতে লাগল শুধু ক্লান্ত মুসা। কিছুই করার নেই তার। কোন সাহায্য করতে পারবে না।
গোড়াতেই সমস্যা দেখা দিল। আগুন জ্বালানোর জন্যে চাই শুকনো। কাঠকুটো। নেই। সব ভিজে আছে আগের দিনের বৃষ্টি আর ভোর রাতের শিশিরে।
তবে জ্বালানীর ব্যবস্থা করা গেল। তুলা ফলের খোসা ভাঙতেই ভেতর থেকে বেরোল শুকনো পেঁজা পেঁজা তুলা। গাছের ডালের ভেজা বাকল কেটে ফেলে দিয়ে বের করা হলো মোটামুটি শুকনো লাকড়ি। তুলোর ওপর বিছিয়ে দেয়া হলো ওগুলো। তুলাতে আগুন ধরলে পরে লাকড়িতেও ধরবে।
এবার পাথর আর ইস্পাত দরকার, ঘষা দিয়ে আগুনের স্ফুলিঙ্গ ফেলবে। তুলায়। ইস্পাত আছে, ছুরিটা। কিন্তু পাথর? আমাজনে পাথরের খুব অভাব, বিশেষ করে বন্যা উপদ্রুত এলাকায়। আর ভাসমান দ্বীপে থাকে পলিমাটি, পাথর থাকার প্রশ্নই ওঠে না।
সারা দ্বীপ আঁতিপাতি করে খুঁজেও একটা পাথর পেল না ওরা।
অন্যভাবে চেষ্টা করল জালানোর। চ্যাপ্টা কাঠে আরেকটা কাঠির মাথা জোরে জোরে ঘষলে উত্তাপে নাকি আগুন জ্বলে ওঠে। সেই চেষ্টাও করে দেখা হলো। ডলে ডলে দু-জনের হাতের চামড়াই শুধু ছিলল, আগুন জ্বলল না।
ইনডিয়ানরা আরেক কায়দায় আগুন জ্বালায়। চ্যাপ্টা কাঠে একটা খাজ কাটে। কাঠির মাথা চোখা করে ওই খাজের ওপর জোরে জোরে ডলে খুব তাড়াতাড়ি। সেই একই ব্যাপার উত্তাপে জ্বলে ওঠে আগুন।
কিন্তু কিশোর আর রবিন চেষ্টা করেও পারল না। আগুন তো দুরের কথা, বোয়াই বেরোল না। এসব কাজের জন্যেও অভিজ্ঞতা আর দক্ষতা দরকার।
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে কাটতে হতাশ হয়ে পকেটে হাত ঢুকিয়ে দিল কিশোর। কি যেন লাগল আঙুলে। আনমনেই বের করে আনল।
চকচকে জিনিসটা কিশোরের হাতে দেখেই চেঁচিয়ে উঠল রবিন। পেয়েছি!
অবাক হয়ে কিশোরও তাকাল হাতের দিকে। হাসি ফুটল।
ক্যামেরার একটা লেন্স। একটা বদল করে অন্য একটা লেন্স লাগানোর সময় এটা খুলে পকেটে রেখেছিল যে, পকেটেই রয়ে গেছে।
ভেজা ধোঁয়ার গন্ধ জীবনে আর এত ভাল লাগেনি কখনও ওদের কাছে। বুক ভরে টানতে গিয়ে বেদম কাশি উঠল রবিনের।
হ্যামকে শুয়ে হি-হি করে হাসল মুসা। ভারিক্কি ভাবটা কেটে গিয়ে হালকা হলো পরিবেশ। অনেকক্ষণ পর হাসি ফুটল তিনজনের মুখে।
পানি ফুটিয়ে আগে পিপাসা মেটাল ওরা।
এবার খাবার। মাছ ধরতে হবে, যেভাবেই হোক। আর কিছু পাওয়া যাবে না এখানে। বড়শির কাটা হয়তো বানানো যাবে, তবে আগে দরকার সূতা। ঘাস। পাকিয়ে বানানোর চেষ্টা করল। শক্ত হয় না, ছিঁড়ে যায়। সমাধান করে দিল একটা ছোট গাছ। এর আঁশ দিয়ে ব্রাশ, ঝাড়ু আর দড়ি তৈরি করা যায়।