এগিয়ে আসছে আরেকটা ভেলা, ছোটখাটো একটা মাঠের সমান। তীর ঘেঁষে চলছে, কোণগুলো ঘষা খেতে খেতে আসছে পাড়ের সঙ্গে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল কিশোর, ওটাতেই উঠবে।
সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় উঠে পড়ল সে, দু-হাতে ধরে রেখেছে হ্যামকের কোণ। অন্য দুই কোণ ধরে রবিনও উঠে পড়ল। খসে গেল কিনারের মাটি, লাফিয়ে সরে গেল সে, কিন্তু হ্যামক ছাড়ল না। দ্বীপের ভেতরের দিকে সরে এসে তারপর নামাল ওটা।
সামনে নদীর বাঁকে বাধা পেয়ে ঘুরতে ঘুরতে গভীর পানিতে সরে এসেছে স্রোত, দ্বীপটাও সরে চলে এল। আজব-যানে চড়ে নিরুদ্দেশ যাত্রায় চলল তিন গোয়েন্দা।
দ্বীপে ওঠাটা পাগলামি মনে হচ্ছে এখন কিশোরের। কিন্তু তীরে বসে মুণ্ড কাটা যাওয়ার অপেক্ষায় থাকার চেয়ে এটা ভাল। যা হওয়ার হবে, ভেবে লাভ নেই। আপাতত জংলীদের হাত থেকে তো রেহাই পাওয়া গেল। তাছাড়া, ভ্যাম্প যেদিকে গেছে সেদিকেই চলেছে ওরা।
ভাসমান দ্বীপের চেয়ে অনেক দ্রুত এগোচ্ছে ভ্যাম্প, সন্দেহ নেই। কারণ সে রয়েছে নৌকায়। দ্বীপের চেয়ে অনেক হালকা, তার ওপর রয়েছে পাল। কিন্তু যদি বাতাস পড়ে যায়? কিংবা কোন বালির ডুবোচরে আটকায়? এমনও হতে পারে, ভেসে যাওয়া কোন গাছের সঙ্গেই আটকে গেল। যদিও সবই অতিকল্পনা, কিন্তু, ভাবনাগুলো আসতেই থাকল কিশোরের মাথায়। ক্ষীণ একটা আশা–যদি ঘটে? যদি ঘটে যায় কোন কারণে?
নিজেদের ভাসমান রাজ্যটা ঘুরেফিরে দেখল কিশোর আর রবিন। পায়ের তলায় মাটি খুব শক্ত, খসে পড়ার ভয় নেই। আধ একর মত হবে। বেশির ভাগটাই ঘাসে ঢাকা। ছোট ছোট গাছপালাও আছে–সিক্ৰোপিয়া, রবার গাছ আর বাঁশ। বাঁশ বেশ লম্বা–দ্রুত গজায় বলে, কিন্তু অন্য গাছগুলো কয়েক ফুটের বেশি না।
হিসেব করে ফেলল কিশোরের হিসেবী মন। দ্বীপটা বছরখানেকের পুরানো। আগের বছরের বন্যায় আধ একর পলিমাটি জমেছিল কোন জায়গায়, বন্যা চলে যাওয়ার পর দ্বীপে রূপান্তরিত হয়েছিল। তার ওপর গাছের চারা গজিয়েছে। এ-বছর স্রোত ওই দ্বীপের তলা কেটে ভাসিয়ে নিয়ে এসেছে আস্ত দ্বীপটাকে, গাছপালাসহ।
কিন্তু বছরখানেকের পুরানো যদি হবে, দ্বীপের শেষ মাথার ওই মস্ত গাছটা এল কিভাবে? দেখেই বোঝা যায়, একশো বছরের কম হবে না ওটার বয়েস। ভালমত পরীক্ষা করে দেখল দু-জনে। বিশাল তুলা গাছ। কাণ্ডটা পানির তলায়, কিন্তু। ডালপালাগুলো ছড়িয়ে উঠে গেছে পঞ্চাশ ফুট ওপরে।
না, এই গাছ এ দ্বীপের নয়। ভেসে আসার সময় গাছটার সঙ্গে ধাক্কা লেগেছিল দ্বীপের, শক্ত হয়ে আটকে গেছে একটা আরেকটার সঙ্গে। ভাল। হ্যামক টানানোর চমৎকার জায়গা। মাটিতে থাকা নিরাপদ নয়। সাপের ভয় আছে। আরও নানা পোকামাকড়, বিশেষ করে সামরিক পিঁপড়ে। বন্যার সময় সবাই আশ্রয় খোঁজে। শুকনো জায়গা দেখলেই উঠে পড়ে।
কিচির মিচির শোনা গেল।
বানর, হাত তুলে দেখাল রবিন।
কিশোরও মুখ তুলে তাকাল। তাদের দিকেই চেয়ে আছে ছোট প্রাণীটা। বানভাসির শিকার।
যানটা মোটামুটি ভালই, টিকবে ভরসা হচ্ছে। এখন প্রধান সমস্যা হলো খাবারের। আলোচনায় বসল দুই গোয়েন্দা।
বাকি দিনটা খাবার খুঁজে বেড়াল ওরা। বাঁশের কোঁড় খুঁজল, কিন্তু সবই বড় বড়। খাওয়ার মত কচি একটাও নেই। একটা ঝোপে ছোট ছোট জামের মত কিছু ফল পেকে আছে। কয়েকটা খেয়েই বমি করে ভাসাল দু-জনে, খাওয়ার অযোগ্য, বিষাক্ত। ছোট একটা গাছ দেখল, আমাজনের বিখ্যাত কাউট্রি বা গরুগাছ। ছাল কাটলে গরুর দুধের মত সাদা কষ বেরোয়, প্রোটিন সমৃদ্ধ। কিন্তু এই গাছটার ছাল কেটে কয়েক ফোঁটার বেশি রস পাওয়া গেল না, একেবারে চারা।
সারভাইভাল এর ওপর যত বই পড়েছে ওরা, প্রায় সবগুলোতেই একটা ব্যাপারে জোর দেয়া হয়েছে… জঙ্গল, মেরু অঞ্চল, মরুভুমি, সাগর, সবখানেই বেচে থাকা যায় সামান্য কষ্ট করলে। কিন্তু এখন তাদের কাছে মোটেই সামান্য মনে হচ্ছে না ব্যাপারটা। এতক্ষণ চেষ্টা করেও খাবারের কোন ব্যবস্থা করতে পারল না।
নদীতে মাছ অনেক আছে। কিন্তু বড়শি বা জাল নেই, ধরবে কি দিয়ে? ইনডিয়ানরা ধরে তীর ধনুক কিংবা বর্শা দিয়ে। ছুরি দিয়ে বাঁশ কেটে, চেঁছে, দুই ঘণ্টা পরিশ্রম করে একটা বল্লম বানানো গেল। কিন্তু দ্বীপের পাড়ে মাছ ধরতে এসে হতাশ হলো ওরা। যা স্রোত, মাছ দেখাই যায় না। বেশি উঁকিঝুঁকি মারতে গিয়ে পানিতে পড়লে শেষ। আর উঠতে পারবে না দ্বীপে।
ইতিমধ্যে এক পশলা বৃষ্টি হয়ে গেল, ভিজিয়ে দিয়ে গেল জামাকাপড়। দুটো হ্যামক টাকা দিয়ে মুসাকে শুকনো রাখা গেছে কোনমতে।
বৃষ্টির পর এল জোর বাতাস। আট-নয় মাইল চওড়া খোলা নদীর ওপর দিয়ে বয়ে গেল তুফানের মত, দাঁতে দাঁতে কাঁপুনি তুলে দিয়ে গেল ছেলেদের। মনে হলো মেরু অঞ্চলে ঢুকেছে ওরা। অথচ রয়েছে বিষুবরেখার খুব কাছাকাছি।
অন্ধকার হওয়ার আগ পর্যন্ত খাবার জোগাড়ের চেষ্টা করল ওরা। কিছুই পেল না। রাতে গাছের ডালে হ্যামক বেঁধে তাতে শোয়াল মুসাকে, আরেকটা দিয়ে ঢেকে দিল, বৃষ্টি এলে যাতে না ভেজে সেজন্যে। বাকি একটা হ্যামকে পালা করে রাত কাটানোর ব্যবস্থা করল রবিন আর কিশোর।
অন্ধকার রাতে এই শীতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন আগুন। জ্বালাতে পারবে না। ম্যাচ নেই। বিকল্প কোন উপায়ে হয়তো জ্বালানো যায়, কিন্তু জংলীরা দেখে ফেলার ভয় রয়েছে।