এই কিশোর, এই, কোথায় যাচ্ছে? শোনা গেল রবিনের চিৎকার।
আরেকটা তীর শিস কেটে গেল কিশোরের কানের পাশ দিয়ে। মাত্র একটা করে তীর আসে কেন? ব্যাপার কি?
কারণটা জানা গেল। মাত্র একজন ইনডিয়ান। দৌড়ে গেল কিশোর।
রাইফেল-বন্দুক চেনা আছে ইনডিয়ানদের। কিশোরের হাতে রাইফেল দেখে ঘুরে দিল দৌড়। চেঁচিয়ে পেছন থেকে ডাকল কিশোর। কিন্তু কে শোনে কার কথা। গতি আরও বাড়িয়ে দিল জংলীটা।
প্রায় আধ মাইল পিছে পিছে গেল কিশোর। কিন্তু লোকটা থামল না। হারিয়ে গেল ঘনবনের ভেতরে, পোড়া গ্রামটা যেদিকে, সেদিকে।
কিশোর বুঝল, নোকটা গুপ্তচর। ভ্যাম্পের চিহ্ন অনুসরণ করে এসেছে। গ্রামে ফিরে গিয়ে এখন জানাবে সব, দলবল নিয়ে আসবে।
ছুটে ক্যাম্পে ফিরে এল কিশোর। একটা মুহূর্ত নষ্ট করা চলবে না এখন। মুসাকে বয়ে নিয়ে গিয়ে তুলতে হবে বজরায়, যত তাড়াতাড়ি পারা যায় নোঙর তুলে পালাতে হবে।
দু-তিন কথায় রবিনকে সব বুঝিয়ে বলল কিশোর। হ্যামক খুলতে শুরু করল। দু-জনে ধরাধরি করে মুসাকে বয়ে নিয়ে এল নদীর পাড়ে।
উত্তেজনায় ভ্যাম্পের কথা ভুলে গিয়েছিল কিশোর, ঝোপঝাড়ের ভেতর থেকে পাড়ের উজ্জ্বল রোদে বেরিয়েই থমকে গেল। ধ্বক করে উঠল বুক।
বজরাটা নেই আগের জায়গায়।
তীব্র স্রোতে ভাটির দিকে ছুটে চলেছে ওটা। পাল তোলা। হাল ধরে থাকা। ছাড়া আর কিছুই করতে হচ্ছে না ভ্যাম্পকে। মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাল ধরে রয়েছে অলস ভঙ্গিতে।
তিন গোয়েন্দাকে দেখে হাত নাড়ল। চেঁচিয়ে বলল, বিদায়, দোস্তরা। নরকে দেখা হবে আবার!
.
১৩.
রাইফেল তুলেও নামিয়ে নিল কিশোর। রেঞ্জ অনেক বেশি। তাছাড়া ম্যাগাজিনে একটি মাত্র বুলেট অবশিষ্ট রয়েছে। তিনটে ছিল, দুটো খরচ হয়েছে ম্যানাটি মারতে।
মাথা গরম করলে চলবে না, নিজেকে বোঝাল সে। হ্যামকসহ মুসাকে মাটিতে নামিয়ে রেখেছে, তার পাশে বসে পড়ল। চিমটি কাটতে শুরু করল নিচের ঠোঁটে।
কতখানি খারাপ অবস্থায় পড়েছে, বোঝার চেষ্টা করছে। নৌকা নেই। সঙ্গে কোন যন্ত্রপাতিও নেই যে বানিয়ে নেবে। শুধু শিকারের ছুরিটা ঝোলানো আছে। কোমরে। চেষ্টা করলে হয়তো একটা ভেলা বানাতে পারবে, কিন্তু তাতে অন্তত এক হপ্তা লাগবে। এত সময় নেই হাতে, আছে বড় জোর এক ঘণ্টা। হয়তো গা পর্যন্ত যেতে হবে না ইনডিয়ান লোকটাকে, ভ্যাম্পকে খুজতে আরও লোক যদি বেরিয়ে থাকে, তাদের সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। ধরার জন্যে ছুটে আসবে ওরা। তাহলে এক ঘণ্টার আগেই আসবে।
জঙ্গলে গিয়ে লুকাতে পারে। কিন্তু বনে টিকে থাকার সরঞ্জাম সঙ্গে নেই, সব রয়ে গেছে বড় বজরায়।
কি কি আছে, হিসেব করল কিশোর। তিনজনের পরনের শার্ট-প্যান্ট, জুতো। তিনটে হ্যামক, একটা ছুরি, একটা রাইফেলে একটি মাত্র বুলেট, ব্যস।
এসব নিয়ে জঙ্গলে লুকিয়ে টিকতে পারবে না। আর লুকাবে কার কাছ থেকে? ইনডিয়ানদের? চব্বিশ ঘণ্টাও বাঁচতে পারবে না, ধরা পড়ে যাবে। সবচেয়ে বড় কথা, জঙ্গলে ঢুকলে ভ্যাম্পের দেখা আর কোন দিনই পাবে না। পাবে না এমনিতেও, তবে নদী পথে এগোনো গেলে ক্ষীণ সম্ভাবনা আছে।
খালের মুখের কাছ দিয়ে ভেসে যাচ্ছে একটা দ্বীপ। ঝিক করে উঠল ভাবনাটা। বিপদের কথা ভাবল না, ঝুঁকি নিতেই হবে, এছাড়া উপায় নেই। বলল, রবিন, জলদি!
কি জলদি, জিজ্ঞেস করল না রবিন। কিশোরকে ঘন ঘন দ্বীপটার দিকে তাকাতে দেখেই অনুমান করে নিয়েছে।
অন্য দুটো হ্যামক গুটিয়ে দিয়ে মুসার হ্যামকে রাখল। তারপর দুজনে মিলে তাকে বয়ে নিয়ে চলল খালের মুখের কাছে।
ঘোলা হয়ে গেছে নদীর পানি। পাক আর স্রোত বাড়ছে। তুমুল বর্ষণ হচ্ছে নিশ্চয় অ্যাণ্ডিজের ওদিকে, পানি সরে আসছে নিচের দিকে। অসংখ্য ছোট-বড় ভাসমান দ্বীপ দেখা যাচ্ছে এখন, ভেসে চলেছে স্রোতে।
সামনে দিয়ে ভেসে চলেছে একটা দ্বীপ। না, এটাতে ওঠা যাবে না। কচুরিপানার সঙ্গে অন্যান্য লতা আর ঝোপ মিশে বিশাল এক ভেলামত তৈরি। হয়েছে। প্রায় পুরোটাই পানির তলায়, ওপরে ভেসে রয়েছে শুধু নাল ফুলগুলো। ফুটখানেক পুরু, ছেলেদের ভার সইবে না। আর যদি সয়ও, অন্য বিপদ আছে। বড় বড় গাছ ভেসে যাচ্ছে, গড়াচ্ছে প্রাচীন স্টীমারের চাকার মত, ওগুলোতে লাগলে ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে কচুরি পানার ভেলা।
ওটাতে উঠল না ওরা।
আরেকটা দ্বীপ এল। ঝোপঝাড় লতাপাতা শক্ত হয়ে লেগে তৈরি হয়েছে। বড় একটা ঝোপ উপড়ে আটকে গিয়েছিল হয়তো চোখা পাথরে, তার সঙ্গে যোগ। হয়েছে আরও ঝোপ, লতাপাতা, গাছের ডাল, ধীরে ধীরে বড় হয়েছে, পাথরের আর সাধ্য হয়নি আটকে রাখার। ছুটে ভেসে চলে এসেছে ভেলাটা। এটাও ভাসমান দ্বীপ, কিন্তু মাটি নেই এতে।
সবচেয়ে আজব দ্বীপ হলো যেগুলোর মাটি আছে, ঝোপঝাড়, এমনকি গাছও আছে। পুরোপুরি দ্বীপ, ভাসমান, এবং সচল। প্রকৃতির এক আজব খেয়াল। কিশোর শুনেছে, ওগুলোর কোন কোনটা দুশো ফুট লম্বা হয়, বিশ ফুট পুরু। গাছপালা, মাটির বোঝা নিয়ে কি করে ভেসে থাকে, সেটা এক বিস্ময়।
বাছবিচারের সুযোগ বা সময় কোনটাই নেই। ঝুঁকি নিয়ে উঠে পড়তে হবে একটাতে। তবে কচুরিপানা কিংবা শুধু ঝোপের তৈরি ভেলায় ওঠা চলবে না।
রবিনকে কথাটা বলল কিশোর। রবিনও একমত হলো। মুসাকে কিছু বলে। লাভ নেই, সে এখনও জ্বরের ঘোরে রয়েছে।