আবার মুখ তুলল, মেরো না, আমাকে দোহাই তোমার! করুণ মিনতি। ওদেরকে ধরতে দিও না। কেটে ফেলবে আমাকে… ধড় থেকে কল্লা আলাদা করে ফেলবে..
সেটাই তোমার উচিত সাজা হবে, কঠিন,কণ্ঠে বলল কিশোর। আমাদের কাছে এসেছ সাহায্য চাইতে। লজ্জা করে না?
শোনো, ভাই, কেঁদে ফেলল ভ্যাম্প, আমরা বিদেশী। শত্রু হলেও এখন বন্ধু। আমাদের একসঙ্গে থাকা উচিত। ওদের হাতে তুলে দিও না আমাকে।
ওদের গাঁয়ে আগুন দিয়েছিলে?
ভুল করে ফেলেছিলাম।
কাউকে মেরেছ?
বেশি না। কয়েকটা জংলী মরলে কি এসে যায়, বলো? উঠে বসল সে, থরথর করে কাঁপছে। আমার পিছু নিয়েছে ওরা।
পুরো এক মিনিট ভ্যাম্পের পেছনে জঙ্গলের দিকে চেয়ে রইল কিশোর। ভাবল, কেন সাহায্য করবে খুনে ডাকাতটাকে?
কিন্তু অবশেষে না করে পারল না। নিরস্ত্র একজন মানুষকে মুণ্ড কাটার জন্যে তুলে দিতে পারল না ইনডিয়ানদের হাতে।
এসো, ক্যাম্পের দিকে হাঁটতে শুরু করল কিশোর।
কাঁপতে কাঁপতে সঙ্গে চলল ভ্যাম্প, বার বার বনের দিকে ফিরে তাকাচ্ছে। ঈশ্বর তোমার ভাল করবেই, ভাই। কোলা ব্যাঙের ঘ্যা-ঘ্যা বেরোচ্ছে গলা দিয়ে। আমি জানি, আমাকে মারবে না তুমি। খুব ভাল ছেলে। তোমার বন্ধুরা কোথায়, ভাই? ওরাও খুব ভাল। জানি, আমাকে কিছু বলবে না। হাজার হোক, সবাই আমরা বিদেশী। ইনডিয়ানদের সঙ্গে কেন হাত মেলাব?
ক্যাম্পে এসে এদিক ওদিক তকাল ভ্যাম্প। তোমার লোকজন কোথায়?
পালিয়েছে।
হারামজাদারা। বেঈমান। ইনডিয়ান তো। বিশ্বাস নেই। জানোয়ারগুলো নিয়ে গেছে?
না। নৌকায় ওই বাঁকের মুখেই আছে।
ফাইন! স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ভ্যাম্প। তোমাদের কপাল খুব ভাল। লোকজন চলে গেছে বটে, কিন্তু আমি এসে পড়েছি। আর কোন চিন্তা নেই। আমাকে বিশ্বাস করতে পারো। আমি নৌকা চালিয়ে নিয়ে যাব ভাটিতে.তা ভাই, খাবার-টাবার আছে কিছু? চব্বিশ ঘণ্টা পেটে দানা পড়েনি।
লোকটাকে খেতে দিল কিশোর।
ওর কি হয়েছে? মূসাকে দেখাল ভ্যাম্প।
জ্বর। ম্যালেরিয়া।
তাই নাকি? খুব খারাপ, খুব খারাপ। তা সত্যিই তোমরা একা? আর কেউ নেই?
ঝট করে মুখ তুলল কিশোর, দৃষ্টি তীক্ষ্ণ। তাতে কি? কোন চালাকির চেষ্টা কোরো না। তুমিও একা। আমাদের কাছে বন্দুক আছে, তোমার কাছে তা-ও নেই: তোমার গলাকাটা দোস্তদের ভেসে যেতে দেখলাম কাল বিকেলে, নিজেদেরই গলা কাটা। তুমি পালালে কিভাবে? ওরা যখন লড়াই করছিল, নিশ্চয়। ঝোপের মধ্যে চোরের মত লুকিয়েছিলে?
আমি হলাম গিয়ে নেতা, কেন ওদের সঙ্গে লড়াই করে মরতে যাব? বেতন। খেয়েছে, কাজ করেছে। যাকগে, ওসব ফালতু আলোচনা করে লাভ নেই। যা। ছিলাম ছিলাম, এখন ভাল হয়ে গেছি। প্রতিজ্ঞা করেছি, জীবনে আর কারও কোন ক্ষতি করব না। কারও একটা চুল ছিডব না, যত টাকাই দিক না কেন আমাকে। অন্যের কাজ করতে গিয়েই তো আজ এই অবস্থা, মরতে মরতে বেচেছি। মার্শ হারামীটা বলল জানোয়ার চুরি করতে, আর আমিও রাজি হয়ে গেলাম.ছিহ! বিশাল একটুরো মাংস মুখে পুরল সে। তোমাদের দেখে যা খুশি হয়েছি না, কি বলব। নিজের মায়ের পেটের ভাইকে দেখলেও এতটা হতাম না।
হ্যাঁ, হাবিল-কাবিলের মত ভাই, টিটকারির ভঙ্গিতে বলল কিশোর।
মানেটা বুঝল না ভ্যাম্প। হেসে বলল, ঠিক বলেছ। জঙ্গলের দিকে চাইল। ফিরে তাকাল পানির দিকে।
ফুলে উঠছে খালের পানি। কিশোরও খেয়াল করেছে ব্যাপারটা। আগের দিন বিকেলে যতখানি ছিল, তার চেয়ে অনেক বেড়েছে পানি। স্রোত চলেছে নদীর দিকে। ভেসে যাচ্ছে উপড়ানো একটা গাছ। শুধু গাছই নয়, বন্যার সময় ভাসমান। দ্বীপও দেখা যায় আমাজনে। কয়েক দিন ধরে দেখা যাচ্ছে। তারমানে আসছে। প্রচণ্ড বন্যা। প্রতিবছরই এই সময়ে বন্যা হয় এ-অঞ্চলে।
ভীষণ বৃষ্টি হচ্ছে উজানে, আনমনে বলল ভ্যাম্প। কিশোরের দিকে ফিরল। এখন যেখানে বসে আছি, আর হপ্তাখানেক পরে এটা থাকবে কয়েক ফুট পানির তলায়। কিংবা হয়তো দ্বীপ হয়ে ভেসে যাবে। চার-পাঁচতলা বাড়ির সমান বড় বড় মাটির টুকরো ভেঙে ভেসে যায় নদী দিয়ে। অদ্ভুত কাণ্ড, না দেখলে বিশ্বাস হয় না। নোকার সঙ্গে ওগুলোর ধাক্কা লাগলে…না না, তোমাদের চিন্তা নেই। নৌকা আমি সামলাব। যেভাবেই হোক, ম্যানাও পৌঁছে দেব তোমাদের খেয়ে-দেয়ে অনেক সুস্থ হয়েছে সে। কুৎসিত হাসিতে হলদে দাঁত বের করে বলল, আর ভয় নেই তোমাদের, আমি এসে গেছি। বুকে হাত রাখল। আমি পৌঁছে দেব।
সাঁ করে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গিয়ে খট করে গাছে বিঁধল একটা তীর।
দুই লাফে ঝোপে গিয়ে ঢুকল ভ্যাম্প। ঝোপঝাড় ভেঙে ছুটল।
কি হলো? বলে উঠল রবিন।
মুসাও,মাথা তুলেছে।
জংলী! ফিসফিসিয়ে বলল কিশোর। মুসা, শুয়ে থাকো।
যেদিক থেকে তীর এসেছে সেদিকে তাকিয়ে চেঁচিয়ে বলল সে, আমরা বন্ধু!
লিংগুয়া জেরাল, অর্থাৎ ইনডিয়ানদের সাধারণ ভাষায় কথা বলেছে কিশোর, বোঝার কথা নয় ওদের। কিন্তু জবাবে আরেকটা তীর উড়ে এল, অল্পের জন্যে তার কাঁধটা বাচল।
নয়টা ধড়ের কথা মনে পড়ল কিশোরের। চট করে তাকাল হ্যামকে শুয়ে থাকা মুসার দিকে। পাশে রবিন। ওদেরকে বাঁচানোর একমাত্র উপায় লড়াইটা এখান থেকে সরিয়ে নেয়া।
ইনডিয়ানরা যেদিকে রয়েছে, একছুটে সেদিকের জঙ্গলে ঢুকে পড়ল সে। হাতে রাইফেল। ওরা বন্ধুত না চাইলে গুলি খাবে।