খুব কাছে থেকে গুলি করল কিশোর।
গুলির শব্দে ঝাঁপিয়ে পড়ে ডুব দিল বড় ম্যানাটি দুটো। ছটফট করছে গুলি খাওয়াটা। তলিয়ে যেতে পারে, এই ভয়ে ছুটে এসে প্রায় মাথায় ঠেকিয়ে আবার গুলি করল কিশোর। রাইফেল বলে মারতে পেরেছে, বন্দুক হলে পারত না। খুব। শক্ত ম্যানাটির চামড়া, ইনডিয়ানরা বর্ম বানায়, শটগানের গুলি হয়তো চামড়াই ভেদ করত না।
দুটো গুলি খেয়েও সঙ্গে সঙ্গে মরল না ম্যানাটিটা। তীরের মাটিতে গরুর মত নাক দিয়ে গুতো মারতে লাগল, তারপর স্থির হয়ে গেল। ডাঙায় তোলার চেয়ে পানি দিয়ে টেনে নেয়া সহজ, খাটনি কম হবে। লেজ ধরে ওটাকে টেনে নিয়ে চলল। দু-জনে।
পিচ্ছিল চামড়া। তাই নৌকায় টেনে তুলতেও বিশেষ অসুবিধে হলো না। খাঁচার দরজার কাছে ম্যানাটিটাকে নিয়ে এল ওরা।
খিদেয় পাগল হয়ে গেছে সাপটা। খাঁচার দরজায় বার বার বাড়ি মারছে মাথা দিয়ে। এরকম চালিয়ে গেলে এক সময় খাঁচা ভেঙে যাবেই। তিরিশ ফুট লম্বা শরীরটা কুণ্ডলী পাকিয়ে রেখেছে। খুব শয়তান জীব। অ্যানাকোণ্ডা কখনও পোষ। মেনেছে বলে শোনা যায়নি। ইনডিয়ানদের বন্ধু বোয়া, কুকুর-বেড়ালের মতই পোষ মানে। কিন্তু সাপের জগতের ডাকাত অ্যানাকোণ্ডাকে এড়িয়ে চলে জংলীরাও। কারও সঙ্গেই ভাব ভাল না দানবগুলোর।
খাবার তো আনা হলো, এখন খাওয়ায় কি করে? খাঁচার দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে ছোবল হানবে কুৎসিত মাথাটা, পা কামড়ে ধরে চোখের পলকে কিশোরকে টেনে নেবে ভেতরে, পাকে জড়িয়ে ভর্তা করে ফেলবে।
কুঁই কুঁই করে ছুটে এল নাক, খিদে পেয়েছে জানাচ্ছে। ক্ষুধার্ত চোখে তার দিকে তাকাল অ্যানাকোণ্ডা, মাথাটা পিছিয়ে নিয়ে বিদ্যুৎগতিতে ছোবল মারল, খাঁচায় বাঁশের বেড়া না থাকলে নাকুর জীবনের ওখানেই ইতি ঘটত।
উপায় পাওয়া গেল। নাকুকে তুলে নিয়ে খাঁচার কোণার কাছে চলে এল কিশোর। সেদিকে চোখ রেখে খাঁচার ভেতরে অনুসরণ করল অ্যানাকোন্তার মাথা, কোণায় চলে এল।
খাঁচার বাইরে কয়েক ফুট দুরে নাকুকে রেখে, রবিনকে ধরতে বলল কিশোর।
স্থির চোখে চেয়ে আছে অ্যানাকোণ্ডা, সম্মোহন করছে যেন। এভাবে সম্মোহন। করে নাকি শিকারকে দাঁড় করিয়ে রাখে, তারপর আস্তে আস্তে এগিয়ে এসে খপ করে ধরে। কিন্তু নাকুর ওপর বিশেষ সুবিধে করতে পারল না সাপ, শক্ত করে ধরে রেখেছে রবিন। তাপিরটাকে নড়তেই দিচ্ছে না।
খাঁচার দরজার কাছে চলে এল কিশোর। অ্যানাকোপ্তার দৃষ্টি অন্য দিকে, এই সুযোগে খাঁচার পাল্লার কিনারে দড়ি পেঁচাল সে। তারপর বাঁধন খুলল। দড়িটা সামান্য ঢিল রেখেছে, দুই-তিন ইঞ্চি ফাঁক হয় টানলে। ম্যানাটির চ্যাপ্টা লেজ। ঢুকিয়ে দিল সেই ফাঁকে। তাপিরটাকে সরিয়ে নিতে বলল।
নিয়ে গেল রবিন।
ম্যানাটির ওর চোখ পড়ল অ্যানাকোণ্ডার। এক লাফে চলে এল মাথাটা। খপ করে কামড়ে ধরে টানতে শুরু করল।
পেঁচানো দড়িতে আরেকটু ঢিল দিল কিশোর, খানিকটা ঢুকল ম্যানাটির শরীর। এভাবে ঢিল দিতে দিতে অনেকখানি ফাঁক করে ফেলল দরজা, টান দিয়ে শিকারের। পুরো শরীরটাই খাঁচার ভেতরে নিয়ে গেল সাপ। তাড়াতাড়ি আবার দরজা বন্ধ করে বেধে ফেলল কিশোর।
অ্যানাকোন্ডা যখন শিকার ধরে, আর কোন দিকে খেয়াল করে না। কি করে শিকার গিলবে, খালি সেই ভাবনা দেখতে দেখতে গিলে ফেলল ভারি ম্যানাটিটাকে।
যাক, কয়েক হপ্তার জন্যে নিশ্চিন্ত, ভাবল কিশোর। পেট খালি না হলে আর গোলমাল করবে না।
বাকি জীবগুলোকে খাওয়াতে লাগল সে। রবিন সাহায্য করছে বটে, কিন্তু। মুসার মত পারছে না। এসবের জন্যে মুসা একাই যথেষ্ট। এই মুহূর্তে সহকারী গোয়েন্দার অভাব খুব অনুভব করছে কিশোর, জানোয়ারগুলোর ভাবভঙ্গিতেও মনে হচ্ছে, ওরা মুসাকে খুঁজছে।
খাওয়াচ্ছে, সেই সঙ্গে ভাবনা চলেছে কিশোরের মাথায়। ভ্যাম্পের ডাকাতদলের সবাই কি মারা গেছে? কতজন লোক ছিল দলে? সেদিন রাতে যখন আক্রমণ করছিল, আট-দশজনকে দেখা গেছে। নৌকায় ভেসে গেছে নয়টা ধড়। দশজন হলে বাকি থাকে একজন। কেন যেন তার মনে হচ্ছে, একজন জীবিত আছেই, ভ্যাম্প। ভ্যাম্পায়ার মরেনি। এত সহজে মরতে পারে না তার মত শয়তান। দিনের বেলা জেগে জেগেই দুঃস্বপ্ন দেখতে লাগল সে। হেসে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করল, পারল না। অমাবস্যার রাতের চেয়ে ভয়ঙ্কর, নির্জন, আর ভূতুড়ে মনে হচ্ছে এখন জঙ্গলটাকে। সঙ্গী আরও দু-জন রয়েছে তবু মনে হচ্ছে বড় একা সে। কালোবনের এই ভয়াবহ নিঃসঙ্গতাবোধ পাগল করে দিয়েছে অনেক অভিযাত্রীকে।
নৌকা থেকে নামল দুজনে।
রবিন গেল মুসার কপালে জলপট্টি দিতে। কিশোর বসে রইল একটা গাছের গোড়ায়। কাজ তেমন কিছু করেনি, অথচ সাংঘাতিক ক্লান্তি লাগছে। ম্যালেরিয়া তাকেও ধরছে না-তো?
মাথায় কারও হাতের স্পর্শ লাগল। না, রোগেই ধরছে। আবল-তাবল কল্পনা। শুরু হয়ে গেছে তাই। কিন্তু চাপ বাড়ছে মাথায়, কল্পনা নয়। ফিরে তাকাল সে। হ্যাঁ, কল্পনাই। নইলে ভ্যাম্পের চেহারা দেখবে কেন? কুৎসিত চেহারাটা আরও কুৎসিত দেখাচ্ছে এখন। শার্ট-প্যান্ট শতছিন্ন, রক্তাক্ত। উষ্কখুষ্ক চুল। গালে-মুখে হাতে কাঁটার আঁচড়।
মাথা ঝাড়া দিয়ে দুঃস্বপ্নটা দূর করতে চাইল কিশোর। পাশে রাখা রাইফেলে হাত দিল। লাফ দিয়ে উঠে পিছিয়ে গেল। রাইফেল তুলল। গুলি করার দরকার হলো না। তার পায়ের কাছে লুটিয়ে পড়ল নিরস্ত্র দুর্বল ভ্যাম্প।