একেবারে নড়ছে না, আশ্চর্য তো!
হঠাৎ ঠাণ্ডা হয়ে গেল কিশোরের হাত-পা।
আরও কাছে এসে গেছে নৌকা। সাঁঝের আবছা আলোয় এখন কিছুটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে নয় জন মানুষকে। কেন কেউ নড়ছে না বোঝা গেল এতক্ষণে। একজনেরও মাথা নেই।
স্রোতের টানে পঞ্চাশ ফুটের মধ্যে চলে এল নৌকা। সাংঘাতিক ভয় পেয়েছে। জিবা, থরথর করে কাঁপছে।
নয়টা মুণ্ডশূন্য ধড়! কাপড় দেখেই বোঝা যাচ্ছে, ওরা ইনডিয়ান নয়।
নিশ্চয় ভ্যাম্পের ডাকাতদল। এতদিন অন্যের গলা কেটেছে, এবার নিজেদের গলাই কাটা পড়ল। জংলীদের গায়ে আগুন লাগানোর পরিণতি।
আতঙ্কিতযেমন হয়েছে, সেই সাথে স্বস্তিও পাচ্ছে কিশোর।
.
১২.
সকালে চোখেমুখে রোদ লাগলে ঘুম ভাঙল কিশোরের। অলস ভঙ্গিতে আড়মোড়া ভাঙল, মুখের ওপর হাত রেখে পড়ে রইল চুপচাপ।
সকালের এই কয়েকটা মুহূর্ত এখানে উপভোগ করে সে। আগুন জ্বালানোর জন্যে এই সময় কাঠ জোগাড়ে ব্যস্ত হয় ইনডিয়ানরা। তাদের অলস কথাবার্তা, কেটলি আর মগের ঠোকাঠুকির শব্দ, ধোয়া আর কফির গন্ধ, ভাল লাগে তার।
কিন্তু আজ এত চুপচাপ কেন? শুধু জঙ্গলের পরিচিত কোলাহল, আর মাঝে মাঝে জংলীদের ঢাকের একঘেয়ে দিডিম দিড়িম।
চোখের ওপর থেকে হাত সরিয়ে কাত হয়ে তাকাল কিশোর। আগুনের পাশে গোল হয়ে বসে থাকার কথা ইনডিয়ানদের, হাতে মগ।
কিন্তু কেউ নেই। জনশূন্য ক্যাম্প।
এমন তো হওয়ার কথা নয়। হ্যামক থেকে নামল কিশোর। গাছের আড়াল থেকে বেরিয়েই যেন হোঁচট খেল। বড় বজরার পেছনে নোঙর করা মনট্যারিয়াটা নেই।
ভয় পেল কিশোর, প্রচণ্ড ভয়। মনকে বোঝাল, নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে গেছে লোকগুলো, নাস্তার জন্যে। কিন্তু তা-ই যদি হবে, সবাই কেন? বড় জোর, দু-জন যাবে, অন্যেরা থাকবে আগুনের কাছে।
ভাটির দিকে যতদূর চোখ যায়, তাকাল সে। কোন নৌকার চিহ্নও নেই।
নিজেকে প্রবোধ দেয়ার আর কোন মানে হয় না। যা সত্য, সেটাকে মেনে নেয়াই উচিত। ইনডিয়ানদের নিয়ে পালিয়েছে জিবা।
রবিনকে ডেকে তুলল কিশোর। মুসা প্রায় অচেতন।
দেখা গেল, শুধু নৌকাটাই নিয়েছে ওরা, মালপত্র সব আছে। এমনকি মনট্যারিয়ায় সেসব জানোয়ার ছিল, সেগুলোকেও রেখে গেছে বড় বজরায়, বোধহয় ভার কমিয়েছে। ছেড়ে দিল না কেন? খাবার, জাল, মাছ ধরার সরঞ্জাম, মূল্যবান কাগজপত্র, ওষুধ, বন্দুক, গুলি, সব রয়েছে। ছোয়ওনি কিছু।
ভীষণ জঙ্গলে একা এখন তিন গোয়েন্দা, অসহায়। মুসা জ্বরের ঘোরে বেহুশ। নরমুণ্ড শিকারীরা খেপে আছে। আগের দিন বিকেলের বীভৎস দৃশ্যটা মনে পড়ল। কিশোরের। শিউরে উঠল। কল্পনা করল, বড় বজরায় জানোয়ারের সঙ্গে তিনটি কাটা ধড়..আর ভাবতে পারল না সে।
দুর্বল কণ্ঠে ডাক দিল মুসা।
তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেল রবিন।
পানি চায় মুসা।
কপালে হাত দিয়ে দেখল রবিন, পুড়ে যাচ্ছে। পকেটেই টেবলেট আছে, পানির সঙ্গে ওষুধও খাইয়ে দিল। সংক্ষেপে জানাল, কি ঘটেছে।
ম্যালেরিয়া চিন্তাশক্তি ঘোলাটে করে দিয়েছে মুসার। রবিনের কথা ঠিকমত বুঝতে পারল না, কিংবা কানেই ঢুকল না। বিরক্ত হয়ে বলল, আমাকে ঘুমাতে দিচ্ছ না কেন?
উঠে চলে এল রবিন।
ইতিমধ্যে আগুন ধরিয়ে ফেলেছে কিশোর। নাস্তা বানাতে বসল দু-জনে। কানে আসছে ইনডিয়ানদের ঢাক। ইস থামে না কেন? পাগল করে দেবে নাকি?
চামচ দিয়ে ডিম আর কফি খাওয়ানো হলো মুসাকে।
তারপর রাইফেল নিয়ে শিকারে চলল, কিশোর আর রবিন। জানোয়ারগুলোকে খাওয়াতে হবে, বিশেষ করে অ্যানাকোন্ডাকে। ক্ষুধায় অস্থির। হয়ে উঠেছে ওটা। লেজের বাড়ি মেরে সমস্ত পানি ফেলে দিয়েছে খোল থেকে। আগে তার পেট ঠাণ্ডা না করে পানি ভরেও লাভ নেই, আবার ফেলে দেবে।
চওড়া খাল। খালের ধার ধরে এগিয়ে চলল দু-জনে। কোন জানোয়ার পানি খেতে এলে গুলি করবে।
হঠাৎ থেমে গেল কিশোর। রবিনকেও থামাল। হাত তুলে দেখাল সামনে। কোমর পানিতে দাঁড়িয়ে আছে একজোড়া ইনডিয়ান দম্পতি, মেয়েটা কোলের বাচ্চাকে দুধ খাওয়াচ্ছে।
ভালমত আরেকবার দেখে হেসে ফেলল গোয়েন্দাপ্রধান। খুদে চোখ, ভোতা নাক আর মোটা ঠোঁট দেখা যাচ্ছে।
গ্রীষ্মমণ্ডলীয় সাগরে কত নাবিক যে বোকা বনেছে ওগুলোকে দেখে। সাগর। থেকে ফিরে এসে গল্প করেছে, মৎসকন্যার দেখা পেয়েছে তারা। ওগুলোর অর্ধেক শরীর মানুষের মত, অর্ধেক মাছের। সাগরের কিনারে পাথরে বসে বাচ্চাকে দুধ খাওয়ায়, চুল আচড়ায়। যা দেখেছে তার সঙ্গে রঙ চড়িয়েছে অনেক বেশি।
নাবিকদের দোষ দেয়া যায় না। এই তো, এইমাত্র কিশোর আর রবিনও তো। বোকা বনল, কাছে থেকে দেখেও।
আরও এগোল দু-জনে। মুখ অনেকটা গরুর মত জীবগুলোর। ম্যানাটি। ব্রাজিলিয়ানরা বলে কাউফিশ, অর্থাৎ গরুমাছ।
ঘন শেওলায় লেজ ডুবিয়ে বসে আছে ম্যানাটি দুটো। মাদাটা বাচ্চাকে দুধ খাওয়াচ্ছে, মদ্দাটা পদের কড়ি খুঁটছে। দশ ফুট করে লম্বা হবে একেকটা, হোঁতকা, টনখানেকের কম হবে না ওজন। অ্যানাকোন্তার প্রিয় খাবার, কিন্তু এতবড়গুলোকে মেরে নিয়ে যাওয়া যাবে না।
পাখনা আর লেজের ঝাপটা শুনে চোখ ফেরাল কিলোর। আরও ম্যানাটি রয়েছে কাছাকাছি। ছোট একটা দেখল, পাঁচ ফুটও হবে না। হ্যাঁ, এইটা হলে চলে। পাড়ের কাছে অল্প পানিতে জলজ ঘাসের ডগা ছিঁড়ে খাচ্ছে জীবটা।