কোনমতে সরে এল সে। লাফিয়ে উঠে দৌড় দিল লেজের দিকে।
প্যাঁচে আটকে রয়েছে মিরাটো। নাক-মুখ দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে। অবশ নিষ্প্রাণ মাথাটা নড়াচড়ায় একবার এদিক ঝুলে পড়ছে, একবার ওদিক। ঘুরে ঘুরে এগিয়ে। চলেছে সাপের মাথার কাছে।
মুখ ঘোরাল সাপটা।
মিরাটোকে বাঁচানোর জন্যে মরিয়া হয়ে উঠল মুসা। বিপদের পরোয়া না করে ছুটে গিয়ে দু-পা ফাঁক করে দাঁড়াল সাপের ওপর, বুড়ো আঙুল দিয়ে টিপে ধরল দুই চোখ। অ্যানাকোন্ডার সবচেয়ে দুর্বল জায়গা।
যন্ত্রণায় মোচড়াতে শুরু করল সাপের শরীর, চাবুকের মত সপাসপ বাড়ি মারছে লেজ দিয়ে। কিন্তু কারও গায়ে লাগছে না, সবাই রয়েছে নিরাপদ দূরতে। প্যাঁচ থেকে খুলে একটা ঝোপের ওপর গিয়ে পড়ল মিরাটোর দেহটা।
চোখ ছেড়ে দিয়ে ছুটে গেল মুসা। মিরাটোর বুকে কান পেতে শুনল, নাড়ি দেখল। নেই। সব শেষ।
উঠে দাঁড়াল আবার সে। কড়া চোখে তাকাল সাপটার দিকে। মিরাটোর মৃত্যু বৃথা যেতে দেবে না।
কিশোরের জ্ঞান ফিরেছে।
টানাটানিতে সাপের গলার ফাঁসটা আরও চেপে বসেছে। দড়ি ধরে খাঁচার দিকে টানতে লাগল তিন গোয়েন্দা। দম বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কাবু হয়ে আসছে অ্যানাকোন্ডা। লেজে আটকানো ফাসের দড়িও টেনে নিয়ে গিয়ে পেচিয়ে ফেলা। হলো আরেকটা গাছে। দড়িটা ধরে রাখল দু-জন ইনডিয়ান, অন্য দু-জন আরেকটা ফাঁস আটকে দিল লেজে।
এরপর আর বিশেষ অসুবিধে হলো না। মাথার দিক থেকে দড়ি টানতে লাগল কয়েকজন, অন্যেরা লেজের দড়ি একটু একটু করে ছাড়তে লাগল। শরীর মুচড়ে, আঁকিয়ে-বাকিয়ে ছাড়া পাওয়ার চেষ্টা করল সাপ, পারল না, ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল খাঁচার দিকে।
অবশেষে বিশাল মাখাটা ঢুকল দরজার ভেতর।
সাপের অর্ধেকটা শরীর খাঁচায় ঢুকে যাওয়ার পর লেজের দড়িতে বেশি করে ঢিল দেয়া হলো। বার দুই এদিক ওদিক নেড়ে মানুষ ধরার চেষ্টা করল লেজটা, তারপর আপনাআপনি ঢুকে গেল ভেতরে। লাগিয়ে দেয়া হলো দরজা।
খুশি হতে পারল না কেউ। অ্যানাকোণ্ডার জন্যে অনেক বেশি মূল্য দিতে হয়েছে।
গায়ের ছেঁড়া শার্ট খুলে ভিজিয়ে এনে মিরাটোর রক্তাক্ত মুখ মুছে দিল মুসা। চোখের পানি ঠেকাতে পারল না। ভালবেসে ফেলেছিল তরুণ ইনডিয়ানকে। আজ একজন বড় বন্ধুকে হারাল তিন গোয়েন্দা।
মিরাটো চলে যাওয়ায় বড় বেশি অসহায় মনে হলো নিজেদেরকে, ভবিষ্যৎ অন্ধকার। লাশের পাশে বসে রইল তিনজনে।
খাঁচাটা নৌকায় তুলল ইনডিয়ানরা। বাথটাবে পানি ভরল। তারপর ফিরে এল কবর খুঁড়তে।
যে গাছের তলায় জীবন দিয়েছে মিরাটো, সেদিন সন্ধ্যায় সেখানেই কবর দেয়া হলো তাকে।
১১.
নদীর ভাটির দিকে একটানা চলেছে বজরা-বহর। সবাই বিষণ্ণ। কিশোরের একমাত্র ভাবনা, কি করে এখন ম্যানাও পৌঁছে স্টীমারে জানোয়ারগুলো তুলবে।
তিন গোয়েন্দার কাছে এখন জঙ্গল শুধু মৃত্যু আর আতঙ্ক।
এই সময় মুসার উঠল জ্বর। অবহেলা করে ম্যালেরিয়া নিরোধক ট্যাবলেট খায়নি নিয়মিত, হ্যামকের ওপর মশারী খাটায়নি। এক রাতের মশার কামড়েই ধরে ফেলেছে। ছোট বজরার টলডোর ছাতে শুয়ে রইল সে।
ভ্যাম্পের দেখা নেই। কিশোর আশা করল, ডাকাতটার হাত থেকে মুক্তি পাওয়া গেছে। কিন্তু একদিন জংলীদের ঢাকের শব্দ কানে এল। একটা বাক পেরিয়ে দেখা গেল গ্রামে আগুন। ভ্যাম্পের দলের কাজ না-তো? ওরা লাগিয়েছে? শিওর হলো কিছুক্ষণ পরই, যখন দেখল, চরের ওপর পড়ে রয়েছে ডাকাতদের নৌকাটা। ভেসে যাওয়ার ভয়ে ডাঙায় তুলে রেখে গেছে।
আতঙ্কিত হয়ে পড়ল কিশোর। মুসা অসুস্থ, মিরাটো নেই, এখন যদি এসে ভ্যাম্পের দল আক্রমণ করে, ঠেকাতে পারবে না। ডাকাতদের অলক্ষে এখন কোনমতে পালাতে পারলে বাঁচে।
আরও মাইল পাঁচেক ভাটিতে একটা খালের মুখে থামল সেদিন রাত কাটানোর জন্যে।
বার বার কান পেতে শুনছে লোকেরা। ঢাক এখনও মাঝে মাঝেই বেজে। উঠছে। অনেক দূর থেকে জবাব আসছে সে-শব্দের। তারমানে খবর দেয়া হচ্ছে। অন্য গ্রামের জংলীদের, দাওয়াত করছে, কিংবা সাহায্যের আবেদন। ঢাকের শব্দে কেপে কেপে উঠছে বন।
ভীষণ ভয় পাচ্ছে কিশোরদের সঙ্গের ইনডিয়ানরা। আগুনের কাছে গায়ে গা ঠেকিয়ে জড়সড় হয়ে বসেছে। ফিসফাস করছে। তাদের আরও উত্তেজিত করে। তুলছে জিবা।
কাছে এসে দাঁড়াল কিলোর। কি হয়েছে, জিবা?
ঢাক, সিনর। এরা ঢাকের শব্দে ভয় পাচ্ছে।
কেন? এক ইনডিয়ান অন্য ইনডিয়ানকে জবাই করবে না।
এক গোত্রের না হলে করবে। এখানকার ইনডিয়ানরা ভারি পাজী, বুনো। বিদেশী মানুষকে দেখতে পারে না, তাদেরকে যারা সাহায্য করে, তাদেরকেও না। তোমাকে ধরতে পারলে খুন করে ফেলবে, সঙ্গে যারা আছে কাউকে ছাড়বে না।
হাসল কিশোর। যতখানি বলছ, ততটা হয়তো নয়। প্রথম থেকেই তো বাড়িয়ে বলা শুরু করেছ।
নদীর ধারে গেল জিবা আর তার সঙ্গীরা, গায়ে কি ঘটছে দেখার জন্যে। উত্তেজিত হয়ে উজানের দিকে কি যেন দেখাচ্ছে আর বলাবলি করছে। পায়ে পায়ে তাদের কাছে চলে গেল কিশোর, রবিন রইল মুসার কাছে।
রক্তাক্ত সূর্যাস্তের পটভূমিতে জংলীদের জ্বলন্ত গায়ের ধোয়া কেমন যেন বিষণ্ণ করে তুলেছে পরিবেশ। কিন্তু সেটা দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি ইনডিয়ানদের, তারা চেয়ে আছে নোকার দিকে। এদিকেই ভেসে আসছে নৌকাটা। দূর থেকেই যাত্রীদের দেখা গেল। কিশোর গুণল, নয় জন। চুপ করে বসে আছে ওরা, দাঁড় বাইছে না।