তার মনে হলো, পানির ওপরে বুঝি আর ওঠা হবে কোন দিনই।
ওপরে মাথা তুলে, সাঁতরে কিভাবে যে তীরে এসে উঠল, বলতে পারবে না সে। হাঁপাতে হাঁপাতে ছুটে এসে ধপ করে বসল ঝোপের কিনারে।
কী? একসঙ্গে প্রশ্ন করল মুসা আর রবিন।
অ্যানাকোণ্ডা..মনে হয় তার বাড়ির ওপরই বসে আছি আমরা…পানির তলা। দিয়ে সুড়ঙ্গ চলে এসেছে ডাঙায়।
আবার অপেক্ষা।
অনেক সময় পেরোল। ঝোপের ভেতরই শুয়ে ঘুমাচ্ছে মুসা। রবিন ঢুলছে। কিশোরের চোখেও ঘুম। একবার পাতা মেলছে, একবার বন্ধ। দেখার কিছু নেই। হরিণটা ঘাস খাচ্ছে, তার পায়ের কাছ থেকে খানিক দূরে ছোট ছোট ঢেউ। ছপছপ করছে পাড়ে বাড়ি খেয়ে।
ছপছপ কিছুটা বাড়ল মনে হলো না? চোখ মেলল কিশোর। হরিণটার জন্যে। প্রথমে চোখে পড়ল না, তারপর দেখল ওটাকে। নড়ছে। সাবমেরিনের পেরিস্কোপের মত। পলকে ঘুম দূর হয়ে গেল। অ্যানাকোন্তা আসছে, কোন সন্দেহ নেই। ডাঙার চেয়ে পানিতে থাকে বেশিক্ষণ ওই সাপ, তাই পানিতে থাকার মত। করেই তৈরি হয়েছে শরীর। নাকটা ওপর দিকে ঠেলে তোলা, পুরো মাথাটা পানির তলায় থাকলেও ফুটো দুটো ওপরে থাকে, শ্বাস নিতে অসুবিধে হয় না।
ঢেউয়ের তলা থেকে মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়ছে চোখ দুটো। এমনভাবে। বসানো; ওপরে, নিচে, সামনে, পাশে সব দিকেই দেখতে পায় অ্যানাকোণ্ডা, আর কোন সাপের এই সুবিধে নেই। দুই চোখের মাঝের দূরত্ব দেখেই অনুমান করতে পারল কিশোর, সাপটা বিরাট।
হরিণের দিকে এগিয়ে আসছে জীবন্ত পেরিস্কোপ। পেছনে অনেক দূর পর্যন্ত পানিতে আলোড়ন, মস্ত প্রপেলার চলছে যেন পানির তলায়, পঁচিশ-তিরিশ ফুটের কম হবে না সাপটা।
নিঃশব্দে ঝোপ থেকে বেরিয়ে গাছের পেছনে চলে এল কিশোর। দড়ি ধরে টেনে সঙ্কেত দিল। মাস্তুলের গোড়ায় বসে পাহারা দিচ্ছে একজন ইনডিয়ান। সতর্ক হয়ে গেল সে। ( তীরে ঠেকল অ্যানাকোণ্ডার থুতনি। বেয়ে উঠে আসতে শুরু করল। ঘাস। খাওয়া থামিয়ে ফিরে তাকাল হরিণ, সাপটাকে দেখেই লাফ মারল। দড়ি না থাকলে তিন লাফে হারিয়ে যেত বনের ভেতর। সেটা তো পারল না, দড়িটাকে টেনে টানটান করে রেখে পা ছুঁড়তে লাগল অনবরত। খুরের ঘায়ে মাটি উড়ে গিয়ে লাগছে সাপের মুখে।
দড়ি টেনে সঙ্কেত দিল আবার কিশোর।
টান দিল মাস্তুলের কাছে বসা লোকটা। আস্তে আস্তে সরিয়ে নিতে লাগল হরিণটাকে।
একটু একটু করে হরিণটা সরছে গাছের দিকে, সাপ এগোচ্ছে তার দিকে। কামড় বসাবার জন্যে মাথা তুলেও নামিয়ে ফেলছে, বার বার সরে নাগালের বাইরে। চলে যাচ্ছে শিকার।
একটা ফাঁসি হাতে মুসা তৈরি। তার পেছনে আর আশেপাশে অন্যেরা।
গাছের গোড়ায় চলে এল হরিণ। সাপটা তার থেকে ছয় ফুট দূরে। দ্রুত আসছে।
এবার! চেঁচিয়ে উঠল কিশোর।
ফাঁস হাতে গাছের আড়াল থেকে লাফিয়ে বেরিয়ে এল মুসা। অন্যেরা। বেরোল দু-দিক থেকে। লেজে ফাঁস পরানোর জন্যে ছুটে গেল দু-জন।
মুসাকে দেখে পিছাল না সাপটা, ভীষণ ভঙ্গিতে মাথা তুলল। সামান্যতম ভুল এখন মারাত্মক বিপদ ডেকে আনতে পারে। ছোবল হানার আগেই সাপের গলায় পরিয়ে দিতে হবে ফাঁস।
ধীরে ধীরে পিছিয়ে যাচ্ছে বিশাল মাথাটা, ফাঁক হয়ে গেছে চোয়াল। তীব্র গতিতে এগিয়ে আসবে যে কোন মুহূর্তে। মুসাও ফাঁস ছুঁড়ল, সাপটাও ছোবল হানল। কিন্তু ধরতে পারল না মুসাকে। লাফিয়ে পাশে সরে গেছে সে। ফাঁসটা মাথা গলে গলার কাছে চলে গেছে। হ্যাঁচকা টানে আটকে দেয়া হলো।
দড়ির আরেক মাথা খাঁচার দরজার ভেতর দিয়ে নিয়ে গিয়ে, পেছনের বেড়ার ফাঁক দিয়ে বের করে গাছের সঙ্গে বেধে রাখা হয়েছে আগেই। জাগুয়ারকে যেভাবে টেনে ঢুকিয়েছে, সাপটাকেও সেভাবেই ঢোকানোর ইচ্ছে। লেজে ফাঁস লাগিয়ে টেনে শরীরটাকে সোজা রাখতে পারলে ঢোকানো যাবে ওভাবে।
কিন্তু মোটেই সহজ হলো না কাজটা।
এক জায়গায় থাকছে না লেজ, খালি এপাশ ওপাশ নড়ছে। অনেক চেষ্টায়। একটা মাত্র ফাঁস পরানো গেল। কিন্তু ধরে রাখতে পারল না লোকটা, হ্যাঁচকা টানে দড়ি ছুটে গেল তার হাত থেকে।
লেজের বাড়িতে চিত হয়ে গেল জিবা আর দু-জন ইনডিয়ান।
আরেকটা ফাঁস হাতে এগোল মিরাটো। এত বেশি কাছে চলে গেল, দড়ির ফাঁস পরানোর আগে সে নিজেই আটকা পড়ল লেজের ফাসে। শরীর মুচড়ে মুচড়ে ফাঁসটাকে ওপরের দিকে সরিয়ে আনছে সাপ। বিচিত্র ভঙ্গিতে ঘুরে ঘুরে সরে, যাচ্ছে মিরাটোর শরীরটা। পুরোপুরি অসহায় সে, কিছুই করতে পারছে না। মুক্তি পাওয়ার জন্যে খালি হাত-পা ছুঁড়ছে।
তাকে সাহায্য করতে এগোল কিশোর।
মিরাটোকে শরীরের মাঝামাঝি জায়গায় নিয়ে এল সাপ, লেজটা মুক্ত করে ফেলেছে। এদিক ওদিক নাড়ছে আবার আরেকজনকে ধরার জন্যে।
কিশোরের ভাগ্য ভাল, ফাসে আটকা পড়ল না, কিন্তু বাড়ির চোটে উড়ে গিয়ে পড়ল কয়েক হাত দূরে। গাছের সঙ্গে ঠুকে গেল কপাল, বেহুশ হয়ে গেল সে।
ছুটে গেল রবিন। টেনেহিঁচড়ে সরাল কিশোরকে। দৌড়ে গিয়ে আঁজলা ভরে পানি এনে ছিটাতে, লাগল তার চোখেমুখে।
মুসার দিকে এগোচ্ছে সাপটা। পিছাতে গিয়ে শেকড়ে লেগে চিত হয়ে পড়ে গেল সে। এই সুযোগে দ্রুত এগোল বিশাল মাথাটা, বিকট হয়ের ভেতর থেকে বাঁকা চোখা দাঁতের ফাঁক দিয়ে লকলক করে বেরোচ্ছে লম্বা জিভ। অ্যানাকোণ্ডার। মানুষ আত্রমণের রোমাঞ্চকর সব গল্প মনে পড়ল তার।