রবিনের দিকে চেয়ে হাসল এক ইনডিয়ান যুবক। চমৎকার স্বাস্থ্য। সে-ই কুমিরটাকে ছুরি মেরেছিল। নাম মিরাটো। হাতের ছুরির আগা আরেকটা কাটা মাথার হায়ের মধ্যে ঢুকিয়ে নাড়া দিল। এত জোরে বন্ধ হলো চোয়াল, ছুরিতে লেগে কয়েকটা দাঁতের মাথা গেল ভেঙে।
ছুরিটা দাঁতের ফাঁক থেকে টেনে ছাড়াল মিরাটো। ফলার দুই পিঠেই গভীর দাগ বসে গেছে।
নিউ ইয়র্ক অ্যাকোয়ারিয়ামে, রবিনের মনে পড়ল, খবরের কাগজে পড়েছিল, একটা পিরানহা কামড় দিয়ে স্টেনলেস স্টীলের কাঁচিতে দাগ ফেলে দিয়েছিল। হাঙরের মতই স্বভাব, একে অন্যকে ধরে খেয়ে ফেলে। অ্যাকোয়ারিয়ামে এক চৌবাচ্চায় দুটো পিরানহা একসঙ্গে রাখে না। রাখলে সবলটা দুর্বলটাকে খেয়ে ফেলে।
ইনডিয়ানরা যে মাছগুলোকে ধরেছে, কয়েকটার পিঠের মাংস নেই, খুবলে খেয়ে ফেলা হয়েছে। মিয়োটো জানাল, বল্লমে গাঁথার পর ওগুলোকে তুলতে সামান্য দেরি হয়েছিল, ওইটুকু সময়েই কামড় বসিয়ে দিয়েছে অন্য পিরানহা। আরেকটু দেরি করলে বল্লমের মাথায় শুধু কঙ্কালটা উঠে আসত।
ওই দেখো, কঙ্কালের কথায় হাত তুলে দেখাল কিশোর।
ফুটন্ত পানি ঠাণ্ডা হয়েছে। চলে গেছে পিরানহার ঝাঁক। অল্প পানিতে পড়ে রয়েছে সাদা একটা কঙ্কাল, মিউজিয়মে দেখা প্রাগৈতিহাসিক দানবের কঙ্কাল বলে। ভুল হয়।
আমাদের গরু-ছাগলেরও ওই দশা করে, মিরোটো বলল। রাতে রক্তচোষা বাদুড়ে রক্ত খেয়ে যায়, ক্ষতের চারপাশে রক্ত লেগে থাকে। সকালে যখন গোসল করতে নামে, ব্যস, হারামী মাছের ঝাঁক এসে হাজির।
এরপর আর ঘুম হলো না কারও।
মুসা আর কিশোর গেল রক্তচাটার জন্যে একটা ক্যাপিবারা শিকার করার জন্য। গাছতলায় আরাম করে বসে রেফারেন্স বই পড়ায় মন দিল রবিন। ইনডিয়ানরা কেউ শুয়ে-বসে গল্প-গুজব চালাল, কেউ রান্নায় ব্যস্ত।
স্বভাব যত খারাপই হোক পিরানহার, মাংস খুব ভাল। রবিন, যে ইনডিয়ানদের খাবার পছন্দ করে না, সে-ও তারিফ করল।
কুমির ধরতে পারলে না বটে, হেসে বলল কিশোর, কিন্তু ভাল লাঞ্চ জোগাড় হলো।
তা হলো, হাত নেড়ে বলল মুসা। কিন্তু আরেকটু হলে আমরাই লাঞ্চ হয়ে যাচ্ছিলাম।
.
০২.
খানিক পর পরই গিয়ে নদীর উজানের দিকে তাকায় কিশোর। ভ্যাম্পের দলবল আসছে কিনা দেখে।
ক্বচিৎ একআধটা ইনডিয়ান নৌকা দূর দিয়ে যেতে দেখল শুধু।
হয়তো এখনও আসেইনি ভ্যাম্প। কিংবা এলেও দ্বীপ আর গাছপালার ওধার দিয়ে চলে গেছে, অভিযাত্রীদের দেখেনি। চলে গেলেও যে আবার ফিরে আসবে না। ভালমত দেখার জন্যে, সেটা বলা যায় না। নিশ্চিন্ত হওয়ার উপায় নেই।
রাইফেল-বন্দুক আছে অভিযাত্রীদের কাছে, তবে তারা তিনজনেই ছেলেমানুষ। ইনডিয়ানদের কাছে রয়েছে শুধু তীর-ধনুক আর বল্লম, গোটা দুই রোগানও আছে। কিন্তু লড়াই লাগলে ভ্যাম্পের গলাকাটা ডাকাতদের সঙ্গে পারবে না ওই অস্ত্র নিয়ে।
তারমানে, লুকিয়ে থাকতে হবে। এই খালপাড়েই কাটাতে হবে দিনটা, রাতের আগে বেরোনো উচিত হবে না। রাত্রে চলতে অসুবিধে হয়তো হবে, কিন্তু উপায় কি?
ভরপেট খেয়ে খালের পাড়ে শুয়ে নাক ডাকাচ্ছে ইনডিয়ানরা। ক্যাতে শোয়ার সাহস নেই কারও। কুমিরের পেটে যাওয়ার চেয়ে পোকামাকড়ের কামড় সওয়া বরং অনেক ভাল।
তিন গোয়েন্দা ও শুয়ে পড়ল।
সবাই গভীর ঘুমে অচেতন। মহিলার আগমন তাই কেউ টের পেল না। এত সুন্দরী, কিন্তু তাকে দেখার জন্যে কেউ জেগে নেই।
মসৃণ কোমল হালকা বাদামী চামড়ার ওপর ঘন বাদামী গোল গোল ছাপ দিয়ে অলঙ্করণ করা হয়েছে, গোল ছাপের মাঝখানটা আবার ফ্যাকাসে। মাথাটা দেখতে কুকুরের মাথার মত। এই মাথায় ভর রেখে খাড়া হয়ে দাঁড়াতে পারে সে। প্রায় দুই মানুষ সমান লম্বা। লাল-কালো আর হলুদ আলপনা কাটা সুন্দর লেজটা পেচিয়ে। রয়েছে গাছের ডালে।
মাটিতে থুতনি ঠেকিয়ে ধীরে ধীরে লেজ খুলতে শুরু করল সে। এক মুহূর্ত খাড়া হয়ে রইল চুপচাপ, লেজের ডগা মাটি থেকে বারো ফুট উঁচুতে। আস্তে করে শরীরটা নেমে এল মাটিতে।
মাথা তুলে ঘুমন্ত শরীরগুলো দেখল সে। খাবার হিসেবে কেমন হবে যাচাই করছে।
নিজের শরীরের তিন গুণ বড় জিনিস গিলে খাবার ক্ষমতা আছে আমেরিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম সাপ বোয়া কনসট্রিকটরের।
সারির প্রথম ইনডিয়ান লোকটার ওপর দিয়ে বয়ে গেল বোয়া, এতই হালকাভাবে, টেরই পেল না লোকটা। পরের জন, তার পরের জন করতে করতে এসে থামল রবিনের ওপর। দেখল। গেলা হয়তো যায়, কিন্তু হজম করতে লাগবে কম পক্ষে ছয় হপ্তা। নাহ, এত ভারি খাবার খেয়ে আরাম নেই। ছোট কিছু দরকার।
বড় বজরা থেকে মৃদু একটা শব্দ আসছে। ফিরে তাকাল বোয়া। মাস্তুলের ওপরে কিকামুর চুল নিয়ে খেলা করছে ময়দা।
রবিনকে ডিঙিয়ে এল বোয়া। কিশোর আর মুসার দিকে ফিরেও তাকাল না। খোলা জায়গাটুকু নিঃশব্দে পেরিয়ে এসে উঠল বজরায়।
থেমে দার্শনিককে দেখল। মাংস-টাংস ভালই, পেটও ভরবে, কিন্তু লম্বুর লম্বা লম্বা শুটকো ঠ্যাঙ আর হাড়ি সর্বস্ব বিশাল ঠোঁটটা নিয়েই ঝামেলা। পালকসহ শরীরটা গিলতে পারলেও পা দুটো বেরিয়ে থাকবে মুখের বাইরে। আর ঠোঁটের মধ্যে না আছে মাংস, না রক্ত, না কোন প্রোটিন। বরং ভেতরে গিয়ে পাকস্থলী ফুটো করে দেয়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। ধরতে গেলেই ঠোকর খেয়ে শরীর। কয়েক জায়গায় ফুটো করে নিতে হবে আগে। থাকগে, কে যায় ঝামেলা করতে।