যাচ্ছেটা কে? জিবার কথা প্রতিবাদ করল কিশোর। সবাই শুনে রাখো, অ্যানাকোণ্ডা ধরার আগে নড়ছি না এখান থেকে। যার থাকতে ইচ্ছে করবে না, চলে যেতে পারো, বাধা নেই।
কিন্তু সে-আগ্রহ দেখা গেল না কারও মধ্যে।
মিরাটোর সঙ্গে আলোচনায় বসল তিন গোয়েন্দা। কি ভাবে সাপ ধরবে, ধরে কোথায় রাখবে, এসব আলোচনা।
খাঁচা তো লাগবেই, মিরাটো বলল। পানি রাখার বড় পাত্রও লাগবে। একনাগাড়ে বেশিক্ষণ পানি ছাড়া থাকতে পারে না অ্যানাকোণ্ডা।
সেটা জানে কিশোর। বিশাল ওই সাপগুলোকে অনেকে এজন্যে জলজ-সাপ বলে। কিন্তু এত বড় পাত্র কোথায়? বাথটাব দরকার।
বানিয়ে নেব। গাছের ছাল দিয়ে।
মিরাটোর ওপর এখন অগাধ ভক্তি আর বিশ্বাস কিশোরের। কি করে বানাবে, জানতে চাইল না। বলল, তাহলে চলো বানিয়ে ফেলি।
তীরে নামল সবাই।
বড় সোজা একটা গাছ বেছে বের করল মিরাটো। পারপলহার্ট জাতের বিশাল গাছ, ছাল বেশ মোটা কিন্তু নরম, কাঠ থেকে সহজেই ছাভিয়ে আনা যায়। গোড়ার কাছে গোল করে কাটল মিরাটো, বিশ ফুট ওপরে আবার চারদিকে ঘিরে গোল করে কাটল। ওপরের কাটা থেকে নিচের কাটা পর্যন্ত সোজা চিরে ফেলল। তারপর নিচের কাটা জায়গা ধরে টেনে ছাড়িয়ে নিল আস্ত ছালটা। বিশ ফুট লম্বা আর দশ ফুট চওড়া একটা ছালের চাদর বেরোল। কলাগাছের আস্ত খোল কেটে দুই ভাজ করে মিশিয়ে, বেধে, পাত্র তৈরি করে তাতে শিং মাগুর জিয়ল এসব মাছ রাখে জেলেরা। ছালটা দিয়ে নিচের দিকে চ্যাপ্টা, ওপরের দিকে গোল ওরকমই একটা বিশাল পাত্র বানানো হলো। বাধা হলো লিয়ানা লতা দিয়ে। দুই ধারেই লম্বা লম্বা দুটো ফাঁক, পানি চোয়াবে সেখান দিয়ে। তাই রবার গাছের আঠা পুরু করে লাগিয়ে বন্ধ করে দেয়া হলো ফাঁক। ব্যস, চমৎকার বাথটাব তৈরি হয়ে গেল, পানি রাখলে পড়বে না।
এরপর একটা খাঁচা তৈরির কাজে লাগল সবাই।
গাধার মত খেটেও খাঁচা বানিয়ে তাতে বাথটাব বসিয়ে বাধতে বাধতে পরদিন দুপুর হয়ে গেল। রাতে পাহারা রাখা হলো, যাতে অ্যানাকোন্ডা এসে আর কোন জানোয়ার চুরি করে নিতে না পারে।
খাঁচা তৈরি শেষ। এবার ফাঁদ পাততে হবে।
বড় বজরার মাস্তুলে একটা দড়ি বেঁধে আরেক মাথা নিয়ে যাওয়া হলো তীরে। চল্লিশ ফুট দূরের একটা গাছের দো-ভালার জোড়ার ওপর দিয়ে দড়িটা পেচিয়ে এনে। অন্য মাথায় বাধা হলো আমাজন হরিণটাকে। ফাঁস তৈরি করা হলো তিনটা, একটা অ্যানাকোণ্ডার গলায় আটকানোর জন্যে, আর দুটো লেজে।
সব তৈরি। এবার সাপ এলেই হয়।
ঝোপের ভেতরে লুকিয়ে বসল শিকারীরা। আবার সেই অপেক্ষার পালা। অনড় বসে থাকা আর থাকা
গড়িয়ে গেল দিন।
পানির কিনারে সারাক্ষণ চরল হরিণটা, তাজা ঘাস ছিঁড়ে খেল। পিপাসা পেলে পানি তো আছেই। খুব সুন্দর একটা জীব। চকচকে চামড়া যেন ট্যান করা, বড় বড় বাদামী চোখ, ডালপাতাওয়ালা দেখার মত শিং। ওটাকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করতে মন খুতখুত করছে কিশোরের, কিন্তু এছাড়া উপায়ও নেই। হরিণ খুবই পছন্দ অ্যানাকোণ্ডার, ডিয়ার সোয়ালোয়ার বা হরিণখেকো ডাকনামই হয়ে গেছে এ-কারণে। আরেকটা হরিণ ধরে আনা, সময়ের ব্যাপার।
তিন ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। আর বসে থাকতে ভাল লাগছে না কিশোরের। সত্যি আছে তো এখানে সাপ বজরার তলায় আসলেই অ্যানাকোণ্ডার বাসা আছে, নাকি ভুল করেছে মিরাটো? অ্যানাকোন্ডার বাসা দেখতে কেমন? কৌতূহল মাথাচাড়া দিয়ে উঠল রহস্যভেদীর মনে। বাড়তে বাড়তে এমন অবস্থায় এল, আর। থাকতে পারল না কিশোর। মুসাকে বলল, চলো।
কোথায়?
অ্যানাকেণ্ডার বাসা দেখব।
ওই পানির তলায় ডুব দিয়ে? দুই হাত নাড়ল মুসা। আমি পারব না, বাবা। আমার সাহসে কুলাবে না।
মুচকি হাসল মিরাটো। চলো, আমি যাচ্ছি।
পানিতে নামল দু-জনে। ঢালু হয়ে নেমে গেছে পাড়। গলা পানিতে নেমে ডুব দিল কিশোর, পাশে মিরাটো। পানি স্বচ্ছ নয়, আবার ঘোলাও না। কয়েক হাতের বেশি দৃষ্টি চলে না। আচ্ছা, পিরানহা নেই তো? আশা করল সে, নেই। জলজ আগাছার মধ্যে ওই মাছের ঝাঁক না থাকার সম্ভাবনাই বেশি।
পানির তলায় তাকিয়ে অ্যানাকোন্ডার বাসা খুজল কিশোর।
আজব এক জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে চলেছে মনে হলো। লম্বা লম্বা লতা, দুলছে। নলখাগড়ার মত এক জাতের ঘাস জন্মে রয়েছে গুচ্ছে গুচ্ছে। পিচ্ছিল, কেমন যেন গা শিরশির করা ওগুলোর ছোঁয়া। কোথাও সোজা কোথাও আড়াআড়ি, একটার ওপর আরেকটা পড়ে আছে মোটা ডাল ও ঝড়ে ভেঙে পড়া গাছের কাণ্ড, কালো কালো। দেখলেই গায়ে কাটা দেয়। ওগুলোর মাঝে ফাঁক এত কম, অ্যানাকোণ্ডার মত বড় প্রাণী থাকতে পারবে না।
দম নেয়ার জন্যে ভাসল কিশোর। তার পাশে মিরাটো। বুক ভরে বাতাস টেনে আবার ডুব দিল। আরও কয়েক হাত এগিয়ে কালো একটা গুহামুখ চোখে পড়ল। মুখটা পানির তলায়, সুড়ঙ্গটা গিয়ে শেষ হয়েছে তীরের কোন শুকনো গুহায়, আন্দাজ করল কিশোর।
ওটা যে সাপের বাসা, তার প্রমাণ মিলল। ফুট পাঁচেক লম্বা দুটো সাপ বেরিয়ে একেবেঁকে ঢুকে গেল নলখাগড়ার জঙ্গলে।
তারপরই দেখা গেল বিশাল আরেকটা মাথা, গুহা থেকে বেরিয়ে ধীরে ধীরে এগোল কিশোরের দিকে। ধ্বক করে উঠল তার হৃৎপিণ্ড।
হাত ধরে হ্যাঁচকা টান মারল মিরাটো, ওপরে ওঠার জন্যে। কিন্তু তার আগেই ওঠার জন্যে ঘুরতে শুরু করেছে কিশোর। জোরে জোরে হাত-পা ছুড়ছে। ভয়, এই বুঝি এসে পা কামড়ে ধরল অ্যানাকোণ্ডা। টেনে নিয়ে যাবে অন্ধকার গুহায়। চিপে শ্বাসরুদ্ধ করে মেরে রসিয়ে রসিয়ে গিলবে।