বন্ধ করে দেয়া হলো খাঁচার দরজা। ফিরে তাকাল জাগুয়ার, দরজার বাশে বার দুই আলতো থাবা মেরে আবার আগের কাজে লাগল।
হপ্তাখানেক ধরে চলবে এখন, হাসছে মিরাটো। এক বিন্দু আঠা গায়ে থাকলেও থামবে না। চাটতেই থাকবে, চাটতেই থাকবে।
তাজ্জব হয়ে গেছে তিন গোয়েন্দা। এত সহজে ধরে ফেলল বাঘটাকে? বিশ্বাস হচ্ছে না তাদের।
এরপর খাঁচাটা নদীর পারে নেয়ার পালা। বিশেষ বেগ পেতে হলো না। কয়েকটা বাশের টুকরোর ওপর দিয়ে ঠেলে ঠেলে নিয়ে আসা হলো ওটা,বাঁশের টুকরো চাকার মত গড়ায়, তার ওপর দিয়ে খাঁচা চলে। জনবল মন্দ নয়, বজরায়। তোলাও খুব একটা কঠিন হলো না। কাজটা আরও সহজ হয়েছে জাগুয়ারটা কোন রকম বাধা না দেয়ায়। সে আছে তার কাজে ব্যস্ত। মাঝে মাঝে শুধু ঘড়ঘড় করে হুশিয়ায় করেছে, ব্যস!
ছোট হলুদ জাগুয়ারটার নাম রাখা হলো মিস ইয়েলো, আর কালোটার নাম মিস্টার ব্ল্যাক, ডাক নাম বিগ ব্ল্যাক।
তোমার দোস্ত, মুচকি হেসে মুসাকে বলল কিশোর। চেহারা-সুরতে অনেক মিল।
যত যা-ই বলো, দাঁত, বেরিয়ে পড়ল মুসার, তোমার ওই জালে। আটকানোর তুলনা হয় না। কথাটা মনে পড়ায় আবার হাসতে শুরু করল সে।
রবিন হাসল।
কিশোরও হাসল এবার। তার আনন্দ বাগ মানছে না। একই দিনে দু-দুটো জাগুয়ার, তার একটা আবার দুর্লভ কালো চিতা। সবাইকে ধন্যবাদ জানাল সে, এমনকি জিবাকেও, যে জাগুয়ার ধরায় কোন সাহায্যই করেনি।
আর একটিমাত্র প্রাণী ধরতে পারলেই পুরোপুরি সন্তুষ্ট হয় কিশোর, অ্যানাকোন্ডা। তবে তার পরেও অনেক কাজ বাকি থাকে–ভ্যাম্পের চোখ এড়িয়ে নদীর ভাটিতে গিয়ে কোন শহরে থেমে স্টীমার ধরা, তারপর বাড়ি ফেরা। কঠিন এবং ঝক্কির কাজ।
.
১০.
এগিয়ে চলেছে বজরা-বহর।
পেরিয়ে এল আরও দু-শো মাইল। ইতিমধ্যে আরও কিছু প্রাণী ধরেছে ওরা–একটা শ্লথ, একটা আরমাডিলো, আর এক জাতের খুদে, খুব সুন্দর একটা আমাজন হরিণ। কিন্তু যার জন্যে বেশি আগ্রহ, সেই অ্যানাকোন্ডারই দেখা পাওয়া গেল না।
একদিন, রাত কাটানোর জন্যে একটা বড় খালে ঢুকল বজরা। এতদিন যেসব খাল দেখেছে, এটা সেরকম নয়। ঝকঝকে বালির চরা নেই। দুই পাড়েই ঘন ঘাস আর কাশবন। খালের পানিতেও নানারকম জলজ তৃণলতা জন্মে আছে।
মিরাটো বলল, এখানে অ্যানাকোণ্ডা না থেকে যায় না।
রাতটা কাটল।
সকালে জন্তু-জানোয়ারের তদারকিতে লাগল মূসা আর কিশোর।
আইবিস পাখিটা গায়েব। যেখানে ছিল, সেখানে এখন পড়ে রয়েছে কয়েকটা পালক। খাঁচাটা চুরমার। ওই কাজ আইবিসের নয়, সে পারবে না। করেছে ভারি, শক্তিশালী কেউ। মাংসাশী জানোয়ারগুলোর দিকে একে একে তাকাল কিশোর, কার চোখে চোরা চাহনি আছে, খুঁজল। চোখ মুদে আরামে রোদ পোহাচ্ছে। ডাইনোসর। তার ক্ষমতা আছে খাঁচা ভেঙে আইবিস বের করে খাওয়ার, কিন্তু গলার দড়ি এত খাটো, খাঁচার কাছেই যেতে পারে না। না, সে নয়। একটিমাত্র, চোখ খোলা রেখে চেয়ে আছে লম্বু-বগা, নিষ্পাপ চাহনী। না, তার কাজও নয়। ইঁদুর, ব্যাঙ আর মাছ খেয়েই কল করতে পারে না, রাতে চুরি করে খাঁচা ভেঙে স্বজাতী খাওয়ার কষ্ট করতে যাবে কোন দুঃখে।
বোয়ার গায়ে খাঁচা ভাঙার মত জোর আছে, পাখির মাংসেও অরুচি নেই। কিন্তু সে রয়েছে অন্য নৌকায়। পেটের শুয়োর এখনও পুরোপুরি হজম হয়নি, তাছাড়া পানিকে তার অপছন্দ। নাহ্, সে-ও নয়।
তাহলে?
বেশি ভাবার সময় পেল না কিশোর। খাঁচার ভেতরে চেঁচামেচি জুড়েছে রক্তচাটা, খাবার চায়।
বোতলে ভরা আছে ক্যাপিবারার রক্ত। ঠাণ্ডা। সেটা আবার রুচবে না, বাদুড়টার, গম চাই, উষ্ণ রক্ত। তাজা না হলেও চলে, কিন্তু গরম হতেই হবে, ধমনীতে প্রবাহিত হওয়ার সময় যতখানি গরম থাকে ততখানি।
একটা পাত্রে এক কাপ রক্ত ঢেলে চুলায় বসাল কিশোর। দেশলাইয়ের কাঠি জেলে আগুন ধরাতে গিয়ে চোখে পড়ল ব্যাপারটা। টলডোর নলখাগড়ায় তৈরি। বেড়ায় মস্ত এক গোল ফোকর। কৌতূহল হলো তার। ভালমত দেখার জন্যে এগোল।
কিসে করল এই ছিদ্র আগের দিনও ছিল না ওটা। রাতে করা হয়েছে। আইবিসের খাঁচা ভাঙা পাখি গায়েব, পড়ে থাকা কিছু পালক, তারপর এই ফোকর…চকিতে মনে হলো তার–অ্যানাকোণ্ডা নয়তো?
রাতে হয়তো নৌকায় উঠেছিল, পাখিটাকে খেয়ে ওদিক দিয়ে পথ করে বেরিয়ে গেছে।
হঠাৎ দুলে উঠল নোকা। আরে, কি ব্যাপার? আমাজনে এত বড় ঢেউ উঠল, যে খাল বেয়ে এসে নৌকা দুলিয়ে দিয়েছে? নাকি ভূমিকম্প? দেখার জন্যে তাড়াতাড়ি টলডো থেকে বেরোল সে।
কই? ঢেউ-টেউ তো দেখা যাচ্ছে না। তীরের দিকে চেয়ে ভূমিকম্পের কোন লক্ষণও দেখল না।
প্রচণ্ড জোরে ঝাঁকুনি লাগল দৌকার ভলায়, কিসে যেন ঠেলা দিয়ে তুলে কাত করে ফেলছে একপাশে তাল সামলাতে না পেরে ডেকের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল কিশোর।
আবার সোজা হয়ে গেল নৌকা।
উঠে কিনারা দিয়ে তাকাল। পানিতে ভয়ানক তোলপাড়।
অ্যানাকোন্ডা। কিশোর আশে এসে দাঁড়িয়েছে মিরাটো, কণ্ঠ কাঁপছে। নৌকার তলায় বাস।
চেঁচাতে শুরু করেছে জিবা, লোকজনদের তৈরি হতে বলছে। এখুনি চলে যেতে হবে এখান থেকে। অ্যানাকোণ্ডা খুব খারাপ। দুষ্ট প্রেত।
এমনিতেই ইনডিয়ানরা সাংঘাতিক কুসংস্কারাচ্ছন্ন, তাদের মনে আরও বেশি ভয় ঢুকিয়ে দিচ্ছে জিবা।