বায় এল না।
রাতে সবাই ঘুমাল, পালা করে পাহারা দিল।
বাঘের পথ, গন্ধে ও-পথে এল না কোন জানোয়ার। বাঘও এল না। ভোরের দিকে ভুল করেই যেন এসে পড়ল ছোট একটা জীব। ইঁদুর গোষ্ঠীর দুই ফুট লম্বা প্রাণী, অ্যাগুটি। আঠার ফাঁদে আটকা পড়ল।
ধ্যাত্তোর। বিরক্ত হয়ে হ্যামক থেকে নামতে গেল কিশোর, প্রাণীটাকে ছাড়ানোর জন্যে।
রাখো, রাখো, বাধা দিল মিরাটো। ভালই হয়েছে। থাক ওটা। ওটার গন্ধেই টিগ্রে আসবে।
বলতে না বলতেই বাঘের চাপা গর্জন শোনা গেল। ঝট করে ঘুরে তাকাল দু জনে।
গুহামুখে বাঘের মাথা।
নিকষ কালো। উজ্জ্বল হলুদ চোখ। অল্প ফাঁক হয়ে আছে মুখ, ঝকঝকে ধারাল দাঁত বেরিয়ে পড়েছে। ইনডিয়ানরা যে বলে ও কালো জাগুয়ার, বাঘের মধ্যে সব। চেয়ে হিংস্র, বোধহয় ঠিকই বলে, দেখে তা-ই মনে হচ্ছে কিশোরের।
গুহার বাইরে বেরিয়ে এসে বসল বাঘ। এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। অনেকক্ষণ থেকেছে গুহার ভেতরে, নিশ্চয় তৃষ্ণা পেয়েছে, নদীতে পানি খেতে যাবে। তার আগে ভালমত দেখে নিচ্ছে আশপাণ্টা। চলার পথে এখন যে জানোয়ার পড়বে। তার কপালে খারাপী আছে।
ঘন বনে ঢোকার জন্যে পা বাড়াল কিশোর।
হাত চেপে ধরল মিরাটো। না, আমাদের পিছু নিতে পারে। ফাঁদ থেকে দূরে সরে যাবে তাহলে।
মুসা আর রবিনের ঘুম ভাঙেনি, অন্য ইনডিয়ানরাও ঘুমিয়ে আছে।
কিশোরকে টেনে নিয়ে দৌড় দিল মিরাটো। বাঘ চলার পথ ধরে ছুটল নদীর দিকে। এখন ফাঁদটা রয়েছে বাঘ আর তাদের মধ্যে। অ্যাগুটির মতই ওরাও বাঘের টোপ হয়ে গেছে।
পেছনে ফিরে তাকাল একবার কিশোর, রওনা হয়েছে বাঘ। সাপের মত নিঃশব্দ মসৃণ গতি। চকচকে ওই কালো চামড়ার তলায় অন্তত দু-শো কেজি হাড় মাংস-রক্ত রয়েছে, অনুমান করল সে। এত ভারি শরীর নিয়ে ওভাবে চলে কি করে!
অস্বস্তি বোধ করছে কিশোর। ভয় লাগছে। যদি মিরাটোর কৌশল বিফল হয়? সাধারণ ওই আঠা আটকাতে পারবে এত শক্তিশালী একটা জানোয়ারকে।
গতি বাড়ছে জাগুয়ারের। দৌড়ে রূপ নিচ্ছে হাঁটা। পা ফেলার তালে তালে এমনভাবে নড়ছে আর কাঁপছে কাঁধের পেশী, মনে হয় যেন পিস্টন চলছে তলায়। তাকালে দৃষ্টি আটকে যায়।
তা-ই গেছে কিশোর আর মিরাটোর। দাঁড়িয়ে দেখছে।
অ্যাগুটির দিকে তাকাচ্ছে না কেন?–ভাবছে কিশোর। খালি আমাদের দিকে চোখ। বোকা হয়ে গেল যেন সে। সম্মোহিতের মত তাকিয়ে আছে বাঘের দিকে, গায়ে এসে লাফিয়ে পড়ার অপেক্ষায় রয়েছে যেন।
চাপা গোঁ গোঁ করল জাগুয়ার। হঠাৎ বন কাপিয়ে গর্জন করে উঠল। জালের কাছাকাছি এসে পড়েছে। অ্যাগুটির ওপর চোখ পড়তেই যেন ব্রেক কষে দাঁড়িয়ে। গেল। লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল আস্তে আস্তে, মাটির সঙ্গে পেট মিশিয়ে ফেলল। চামড়ার তলায় থিরথির করে কাঁপছে মাংসপেশী, দেখা যাচ্ছে। নড়ছে লেজটা, বাড়ি মারছে মাটিতে।
অবিশ্বাস্য রকম দ্রুত গতিতে লাফ দিল।
একলাফে বারো ফুট পেরিয়ে এসে পড়ল আশুটির ওপর। ঘাড় কামড়ে ধরল।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ছেড়ে দিল আবার। পায়ের তলার আঠা নজর কেড়েছে।
এইবার দেখা যাবে-ভাবল কিশোর-মিরাটোর আঠা কতখানি কাজের? কত শক্ত? সামনের এক পা তুলছে বাঘ। তুলে ফেলল, আঠায় আটকে রইল না। থাবা, সাদা আঠায় মাখামাখি। আরেক পা তুলে অবাক হয়ে দেখল, একই জিনিস লেগে রয়েছে।
আর দেখার ইচ্ছে নেই কিশোরের। চেঁচিয়ে বলল, চলো, ভাগি! আঠায়। আটকাবে না।
কিশোরের বাহু খামচে ধরল মিরাটো। দাঁড়াও! দেখো।
চেটে আঠা ছাড়ানোর চেষ্টা করল বাঘ। পারল না। রাগে কামড় মারল থাবায়। ফল হলো আরও খারাপ, মুখেও লেগে গেল আঠা। ডলে মুখ থেকে ছাড়াতে গিয়ে লাগল চোখের আশেপাশে। আঠা ছাড়ানোর চেষ্টায় শুয়ে পড়ল সে, লাগল পেটে। পাগল হয়ে গেল যেন। যতই ছাড়ানোর চেষ্টা করে, আরও বেশি করে লাগে।
এতক্ষণে বুঝল কিশোর ঘটনাটা। তার এক নানী-মেরি-চাচীর মা–বলেন, বেড়ালকে ব্যস্ত রাখতে চাইলে তার পায়ে ভালমত মাখন মাখিয়ে দাও। ওই মাখন ছাড়াতেই হিমশিম খেয়ে যাবে সে, তোমাকে বিরক্ত করবে কখন?
জাগুয়ারও বেড়ালের জাত, পরিষ্কার থাকতে পছন্দ করে, আঠা ছাড়ানোর। ব্যস্ততায় তাই মানুষ আর অ্যাগুটির কথা ভুলে গেল বেমালুম।
মুসা, রবিন আর ইনডিয়ানরা জেগে গেছে। কি হচ্ছে দেখতে এল। জাগুয়ারের এক চোখ পাতায় ঢেকে গেছে, আরেক চোখে আঠা, ফাঁক দিয়ে আবছামত দেখতে পেল মানুষগুলোকে। চাপা গর্জন করে ধমক লাগাল, এগোতে মানা করছে। তারপর আবার আঠা পরিষ্কারে মন দিল। বেড়ালের মতই পেছনের পায়ের ওপর বসে লম্বা জিভ বের করে চাটছে শরীরের এখানে ওখানে।
এবার ধরা যায়, বলল মিরাটো।
ইনডিয়ানদেরকে খাঁচাটা আনতে বলল সে।
খাঁচা এলে, জালের দড়ি দরজা দিয়ে ঢুকিয়ে পেছনের দেয়ালের ফাঁক দিয়ে। টেনে বের করল। দড়ি ধরে আস্তে টানতেই টান পড়ল জালের কোণের চারটে শূপে। অন্যেরাও এসে হাত লাগাল তার সঙ্গে।
আস্তে, হুশিয়ার করল মিরাটো। আরও আস্তে।
জালের আলতো টান লাগল বাঘের পেছন দিকটায়। সামান্য এগিয়ে বসল ওটা, আঠা চাটার বিরাম নেই। আবার টান লাগলে আরেকটু এগিয়ে বসল। ইঞ্চি ইঞ্চি করে এভাবে নিজের অজান্তেই এগিয়ে আসতে লাগল খাঁচার দিকে।
দরজার ভেতরে বাঘের শরীর অর্ধেক ঢুকে যেতেই জোরে টানল মিরাটো। জালের পেছনের দুটো কোণ উঠে এল জাগুয়ারের কাঁধের ওপর, আরেকবার টানতেই খাঁচায় ঢুকে পড়ল ওটা। ফিরে না চেয়ে জোরে ধমক দিল একবার। যেন বলল, উঁহু, জালাল দেখছি। আমি মরি আঠার যন্ত্রণায়। এই চুপ থাকো, নইলে দেখাব মজা। আবার আঠা পরিষ্কার করতে লাগল।