ঢিবঢিব করছে বুকের ভেতর। কিশোরের ভয় হলো, তার হৃৎপিণ্ডের শব্দ চমকে দেবে বাঘটাকে।
আলো দুটো দেখা যাচ্ছে।
টর্চ নড়তেই আবার গর্জন। সামান্য আগে বাড়ল আলোদুটো।
এবার দেখল, কিশোর। কুচকুচে কালো মুখ। কালো শরীর। বুকের খাঁচায়। ধড়াস করে যেন আছাড় খেলো তার হৃৎপিণ্ডটা।
আমাজনের জঙ্গলের মহামূল্যবান সম্পদ, দুর্লভ কালো জাগুয়ার। যে কোন চিড়িয়াখানা লুফে নেবে, অনেক দামে।
পিস্তল উদ্যত রেখেছে কিশোর, কিন্তু ব্যবহার করতে পারবে না, জানে। করলে ক্ষতি ছাড়া লাভ হবে না। পিস্তলের গুলি ঠেকাতে পারবে না ওটাকে, মাঝখান থেকে জানোয়ারটাকেও হারাবে, তার নিজেরও প্রাণ যেতে পারে।
খুব সাবধানে পিছাতে শুরু করল কিশোর। একটা পার্থরের সঙ্গে হোঁচট লাগল, উল্টে পড়তে পড়তে সামলে নিল কোনমতে। ততক্ষণে যা হওয়ার হয়ে গেছে, ভড়কে গেছে জাগুয়ার। লাফিয়ে এসে পড়ল। থাবার প্রচণ্ড আঘাতে চুরমার হয়ে গেল বাঁশটা, টর্চ ভেঙে নিভে গেল।
বাঁশ ফেলে দিয়ে ঘুরে দৌড় দিল কিশোর। উন্মাদের মত ছুটে এসে পড়ল। গুহামুখের জালে। ঠেলার চোটে কোণগুলো ছুটল ঠিকই, সে জড়িয়ে গেল জালে। পেছনে কালো জাগুয়ারের ভীমগর্জন। রাগিয়ে দেয়া হয়েছে তাকে।
ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে রয়েছে লোকজন। তাদের হাতের দড়িতে টান পড়ল- ধরেই নিল তারা, জালে বাঘ পড়েছে। হ্যাঁচকা টানে তুলে ফেলল কয়েক ফুট। ভারি লাগছে। শিকার যে পড়েছে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। টেনে আরও ওপরে তুলে ফেলল জাল।
আড়ালে বসেছে, গুহামুখটা দেখা যায় না। কিন্তু জালটা ওপরে উঠতেই দেখা গেল। সবার আগে দেখতে পেল মুসা। চোখ বড় বড়, হাঁ হয়ে গেল মুখ, কথা। ফুটছে, না। এ-কি! হেসে উঠল হো হো করে। রবিন হাসল। হেসে ফেলল ইনডিয়ানরাও। হাসির হুল্লোড় উঠল।
শিকার হাতছাড়া হয়ে গেছে। গর্তের মুখে দাঁড়িয়ে বার দুই ধমক দিল জাগুয়ার। আবার ঘরে ঢুকলে দেখাবে মজা; বোধহয় এটাই শাসিয়ে ফিরে গেল।
জালে ঝুলছে গোয়েন্দাপ্রধান। মাথা নিচে, ঠ্যাঙ ওপরে, জালের খোপ দিয়ে। বেরিয়ে ঝুলিছে দুই হাত এর চেয়ে মজার দৃশ্য আর আছে। হাসতে হাসতে মাটিতে শুয়ে পড়ল মুসা, পেট চেপে ধরে পা ছুড়ছে।
রবিনেরও মুখ দিয়ে ফেনা বেরিয়ে যাওয়ার জোগাড়, চোখে পানি এসে গেছে। কিন্তু হাসি থামাতে পারছে না। তাতে সুড়সুড়ি দিচ্ছে মুসার হাসি, আরও বেশি। হাসি আসছে।
হাসির কি হলো? ধমক দিল কিশোর, গলায় জোর নেই। নামাও। জলদি নামাওঃ::রাখো রাখো, আগে দেখো গুহার মুখে বাঘটা আছে কিনা।
বাঘ নেই দেখে জাল নামানো হলো। বেরিয়ে এল কিশোর।
হোওহ-হোহ্ হা-হা! হাসি থামছে না মুসার। দা গ্রেট টাইগার ম্যান! বাঘ ধরতে গুহায় ঢুকেছে! হা-হা-হা!
হাসছে রবিন।
রবিন, ইসসি, কি একখান মওকা গেল! হাসতে হাসতে বলল মূসা, তোমার ক্যামেরাটা থাকলে…ওই ছবি ইস্কুলে ভাড়া দিতে পারতাম…হো হো-হো!
.
০৯.
আলোচনা-সভা বসল কি করে ধরা যায় কালো জাগুয়ার?
একেকজন একেক কথা বলল।
ধরতেই হবে ওটাকে, ঘোষণা করল কিশোর। সুন্দরবনের বাঘও এত দামী নয়।
কিন্তু কিভাবে? প্রশ্ন রাখল মুসা।
গতকাল থেকেই তো চেষ্টা হচ্ছে, রবিন বলল, ফাঁদে তো পা দিল না। ব্যাটা খুব চালাক।
একটা কথাও বলছে না মিরাটো। একমনে কাজ করে যাচ্ছে চুপচাপ। রুটিফুল গাছের রস দিয়ে আঠা তৈরি করছে, খুব ঘন।
ইনডিয়ানরা পাখি ধরতে ব্যবহার করে এই আঠা। যেখানে সব সময় পাখি। বসে গাছের সে-ডালে আঠা মাখিয়ে রাখে। বসলে আর উঠতে পারে না পাখি, পা আটকে যায়। ছোটার জন্যে ছটফট করে, পাখায় লাগে আঠা, ডানা জড়িয়ে যায়। উড়তেও পারে না। ধরা পড়ে শিকারীর হাতে।
পাখি ধরার জন্যেই আঠা বানাচ্ছে মিরাটো। দুপুরে পাখির মাংসের রোস্ট খাওয়ার ইচ্ছে হয়েছে।
বানাতে বানাতেই থমকে গেল সে, মুখ তুলে তাকাল কিশোরের দিকে। মাথায় একটা ফন্দি এসেছে। আঠা দেখিয়ে বলল, এ-জিনিস দিয়েই বাঘ ধরব।
হেসে উঠল কিশোর। পাখি আর বানর ধরতে পারবে, তা ঠিক। বাঘ ধরতে পারবে না, অন্তত এই আঠা দিয়ে নয়।
বাঘই ধরব, চ্যালেঞ্জ করে বসল মিরাটো। আমার দাদা নাকি একবার ধরেছিল। সঙ্গী ইনডিয়ানদের সাক্ষি মানল, কি মিয়া, ধরেনি? শুনেছ না?
মাথা নাড়ল ইনডিয়ানরা, শুনেছে।
বিশ্বাস হলো না কিশোরের। তবু মিরাটো যখন বলছে..
ঠিক আছে, মাথা কাত করল সে। পারলে ধরো। আমার কথা হলো, ধরা চাই। পালিয়ে যেতে দেয়া চলবে না।
পাখি ধরা চুলোয় গেল, লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল মিরাটো.। উত্তেজিত কথার ফুলঝুরি ছোটাল সঙ্গীদের দিকে চেয়ে। ছুটাছুটি শুরু হয়ে গেল। জোগাড় করে আনল আরও আঠা!
গুহা থেকে বেরিয়ে কোনদিকে যায়, বাঘ চলাচলের সে-পথটা খুঁজে বের করল। ভালমত দেখে নিশ্চিত হয়ে নিল, তারপর গুহার কয়েকশো ফুট দূরে ফাঁদ পাতল।
গুহামুখে যে জালটা পাতা হয়েছিল, সেটা খুলে এনে বিছাল বাঘ চলাচলের এ পথে। পাতা দিয়ে ঢেকে দিল, যাতে দেখা না যায়। তার ওপর পুরু করে ফেলল আঠা। সেই আঠার ওপর আবার পাতা ছড়িয়ে দিল।
ব্যস, সন্তুষ্ট হয়ে বলল মিরাটো। এবার শুধু চুপ করে বসে থাকা।
অপেক্ষা আর অপেক্ষা। কত আর বসে থাকা যায়? ক্যাম্প থেকে হ্যামকগুলো সরিয়ে আনা হলো ফাঁদের কাছে। ঝোপঝাড়ের আড়ালে গাছে ঝুলিয়ে শুয়ে পড়ল তাতে তিন গোয়েন্দা। বাকি দিনটা পড়ে পড়ে ঘুমাল।