গায়ে লাগছে সাঁঝের ফুরফুরে হাওয়া। পশ্চিম আকাশে রঙের খেলা। পাখি আর বানরের কিচির-মিচির কমতে কমতে থেমে গেল।
তবু মহারাজের দেখা নেই।
এভাবে হবে না, বলল মিরাটো।
আর তো কোন উপায়ও দেখছি না, হতাশা ঢাকতে পারল না কিশোর।
আছে। উপায় আছে। চলো, নৌকায় চলো।
বসে থাকতে থাকতে কিশোরেরও ভাল লাগছে না, উঠতে পেরে খুশিই হলো। সঙ্গে একজন ইনডিয়ানকে নিল মিরাটো। অন্যেরা বসে রইল দড়ির কাছে, মুসা আর রবিন, সেখানেই থাকল। জালও পাহারা দেবে, ইনডিয়ানদেরও। ব্যাটাদের বিশ্বাস নেই, সুযোগ পেলেই ফাঁকি দেয়।
ছোট বজরার দড়ি খুলল মিরাটো। দাঁড় বেয়ে চলল দুই ইনডিয়ান। চুপচাপ পাটাতনে বসে রইল কিশোর।
মাঝ নদীতে এসে নৌকা থামাল। দাঁড় রেখে শিঙ্গা মুখে লাগাল মিরাটো।
না হেসে পারল না কিশোর। বাঘের ডাক এত নিখুঁতভাবে বাঘও ডাকতে পারবে কিনা সন্দেহ।
নদীর পানি কি শান্ত দেখছ, এক সময় বলল মিরাটো। এমন রাতে সাঁতার কাটতে ভালবাসে টিগ্রে। মাছ ধরে। তখনই তাকে ধরতে সুবিধে। পানিতে জোর পায় না।
বিরতি দিয়ে দিয়ে ডেকে চলল সে।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা পেরোল। নদীর খোলা বাতাসে শীত করছে কিশোরের। ঘুমে। জড়িয়ে আসছে চোখ। আগে ভাবত, বাঘ শিকারে সাংঘাতিক উত্তেজনা আর আনন্দ, কিন্তু এখন বুঝতে পারছে, বিরক্তকরও বটে। আহ, হ্যামকে শুয়ে এখন গায়ের ওপর ভারি কম্বল টেনে দিতে পারল:
আসছে, অনেক দূর থেকে যেন কানে এল মিরাটোর কণ্ঠ।
চোখ মেলল কিশোর। তীরের কাছে পানিতে মৃদু ছপছপ শোনা যাচ্ছে, আর কুমিরের কান্নার মত একটা শব্দ।
আবার ডাকল মিরাটো।
জবাব এল। কান্নার সঙ্গে কাশি মেশানো, মুখে পানি ঢোকায় অস্পষ্ট শোনাল আওয়াজটা।
বাঘ!
ঝট করে সোজা হলো কিশোর। ঘুম পালিয়েছে। ভাল করে তাকাল। তারার আলোয় আবছামত দেখা যাচ্ছে মাথাটা।
থামল ওটা, বাঘই, কোন সন্দেহ নেই। ছোট। এদিক ওদিক নড়ল, দ্বিধা করছে এগোতে। বোধহয় বোঝার চেষ্টা করছে, কোনদিকে আছে তার সাথী।
আস্তে আবার শিঙ্গায় ফুঁ দিল মিরাটো।
এগোতে শুরু করল আবার বাঘ।
উত্তেজনায় কাঁপছে কিশোর। কি করতে চাইছে তরুণ ইনডিয়ান?
নৌকার কিনারে চলে এল বাঘ। মাথাটা, আর লেজের খানিকটা পানির ওপরে, শরীর নিচে। ইচ্ছে করলে হাত বাড়িয়ে লেজ চেপে ধরা যায়, এত কাছে। সু তা-ই করল মিরাটো। শিঙ্গা রেখে হঠাৎ বাঘের লেজ চেপে ধরল। টেনে। তুলে ফেলল ওপর দিকে। ইনডিয়ান লোকটার নাম ধরে চেঁচিয়ে বলল, জলদি ছোটো, জলদি।
পাগলের মত দাঁড় বাইতে লাগল লোকটা।
নৌকা ছুটল। লেজ টেনে বাঘের পেছনের অনেকখানি পানির ওপরে তুলে ফেলেছে মিরাটো। মাথা ডুবে গেছে, তুলতেই পারছে না জানোয়ারটা। শ্বাসও নিতে পারছে না। অসহায় ভঙ্গিতে ছটফট করছে শুধু। লড়াই তো দূরের কথা, বেশিক্ষণ এই অবস্থা চললে দম বন্ধ হয়েই মরবে।
আস্তে আস্তে থেমে গেল বাঘের নড়াচড়া। ভেজা তুলোর বস্তা টেনে নিচ্ছে যেন এখন মিরাটো। দাঁড় বাওয়া থামাতে বলল।
নৌকায় তুলে নেয়া হলো বাঘটাকে। ছোট, বেশি ভারি না। যেটাকে সেদিন। মারা হয়েছে, তার তুলনায় বাচ্চা।
জাল এনে তার ওপর শুইয়ে দেয়া হলো বাঘটীকে। নড়ছেও না। মরে গেল নাকি? সাবধানে বুকে হাত রাখল কিশোর। না, ধুকপুক করছে।
নড়ে উঠল বাঘ।
লাফিয়ে সরে এল কিশোর। মিরাটো, জলদি! জাল!
দ্রুত জালের চার কোণ এক করে বেঁধে ফেলা হলো। হুশ ফিরেছে বাঘের। গোঁ গোঁ করছে আর জালের খোপ দিয়ে পা বের করে থাবা মারার চেষ্টা করছে। কিন্তু সুবিধে করতে পারল না, আটকা পড়েছে ভালমত। শূন্যে তুলে জালশুদ্ধ তাকে বাধা হলো মাস্তুলের সঙ্গে। ঝুলে থেকে বৃথাই অসহায় তর্জন-গর্জন চালাল টিগ্রে।
সকালে আরেকটা খাঁচা বানাতে হবে, বলল কিশোর।
কেন? খাঁচা তো আছেই? মিরাটো বলল।
তা আছে। কিন্তু গুহার মুখে জালও পাতা আছে। একটা ধরেছে, আরেকটা বাঘ ধরার লোভ ছাড়তে পারছে না কিশোর। বড় একটা।
ভোরের আলো ফুটল। কিন্তু সুড়ঙ্গের ভেতর থেকে বাঘ বেরোল না।
ঢুকে দেখবে নাকি?- ভাবল কিশোর। নাহ, বেশি ঝুঁকি হয়ে যাবে। কি একবার যখন মাথায় ঢুকেছে, কথাটা খোঁচাতে থাকল তাকে। শেষে উঠেই পড়ল। ঢুকবে, তারপর যা হয় হবে। গন্ধ আছে, বাঘ নেই, তাহলে গেল কোথায়? কোন রহস্যের সমাধান না করা পর্যন্ত তার স্বস্তি নেই।
সবাই বাধা দিল, ঠেকাতে পারল না। যাবেই সে। একটা বাঁশের টুকরোর মাথায় টর্চ বেধে হাতে নিল, আরেক হাতে মুসার বাবার পিস্তল। আশা, বাঘের প্রথম আঘাত আলো আর বাশের ওপর দিয়ে যাবে।
জালের এক কোণা তুলে সুড়ঙ্গে ঢুকল কিশোর।
অন্ধকার সুড়ঙ্গ, কয়েক পা এগিয়েই বয়ে মোড় নিয়েছে। বাতাসে বাঘের গায়ের গন্ধ তীব্র। মোড় নিতেই চাপা গর্জন কানে এল। হঠাৎ শীত করতে লাগল। কিশোরের। বোকামিই করে ফেলেছে!
বাঁশটা নেড়ে এখানে ওখানে আলো ফেলল। কিছুই নেই, শুধু দুটো আলোর গোলক
আরেকবার গোঁ গোঁ শব্দ।
কিন্তু বাঘ কই? আলো দুটো যদি চোখ হয়, পেছনে তো শরীরটা থাকবে। হলদে-কালো রঙ কই?
টর্চের আলো নড়তেই আবার হলো গর্জন।
কিশোর জানে, কোন জানোয়ারই আত্রান্ত না হলে সহজে মানুষকে আক্রমণ করে না। এক পা-ও আর এগোল না সে, তাহলে নিজেকে কোণঠাসা ভেবে। বসতে পারে জানোয়ারটা। তাড়াহুড়ো করে পিছিয়েও আসা যাবে না। তাহলে ও লাফিয়ে এসে পড়তে পারে বাঘ। মোটকথা, এখন কোন ভাবেই চমকে দেয়া যাবে না ওটাকে।