কিন্তু মুসা আর দেরি করল না। রাইফেল তুলে গুলি করেই সরে গেল।
এত জোরে চেঁচিয়ে উঠল জিবা, মনে হলো গুলিটা সে-ই খেয়েছে।
গর্জে উঠল জাগুয়ার। মুখ ফিরিয়ে তাকাল। নতুন শত্রুদের দেখে আরেকবার গর্জন করে লাফ দিল পনেরো ফুট ওপর থেকে। চোখের পলকে এসে পড়ল মুহূর্ত আগে মুসা যেখানে ছিল সেখানে।
জাগুয়ারের একেবারে গায়ে নল ঠেকিয়ে গুলি করল কিশোর।
কাত হয়ে পড়ে গেল জীবটা। পরক্ষণেই গা ঝাড়া দিয়ে উঠে দাঁড়াল আবার যেন কিছুই হয়নি।
আবার গুলি করল মুসা। তাড়াহুড়োয় মিস করল।
গুলি করল কিশোর। পড়ে গিয়ে আবার উঠল জাগুয়ার। মুখে রক্ত। গর্জাচ্ছে। বাতাসের সঙ্গে নাক দিয়ে রক্তের ছিটে বেরোচ্ছে, মুখের কষেও রক্ত। কিন্তু থামল না। শাঁই শাঁই দুই থাবা চালাতে চালাতে ছুটে এল। মস্ত হাঁ, রক্তে মাখামাখি হয়ে। যাওয়ায় বিকট দেখাচ্ছে।
বন্দুকের দুটো নলই খালি। বোকার মত হাঁ করে চেয়ে আছে কিশোর।
গুলির পর গুলি করে চলেছে মুসা। কিন্তু বাঘের গায়ে লাগছে বলে মনে হলো না।
আর কিছু না পেয়ে একটা বাঁশের টুকরো তুলে নিয়ে ধা করে বাঘের পিঠে বসিয়ে দিল রবিন। ঘুরে তাকে ধরতে গেল জানোয়ারটা।
ভয়ে যে যেদিকে পারল ছুটে পালাল ইনডিয়ানরা। কিন্তু মিরাটো গেল না। বল্লম নিয়ে সাহায্য করতে এগোল তিন গোয়েন্দাকে। ইনডিয়ানদের বাঘ মারার বিশেষ বল্লম, দুই দিকেই ফলা।
ভয়ানক গর্জন করে, মুখ দিয়ে রক্তের ফোয়ারা ছিটিয়ে নতুন শত্রুকে সই করে। লাফ দিল বাঘ। শা করে পাশে সরে বল্লম বাড়িয়ে দিল মিরাটো। বাঘের বুক ছেদা করে ঢুকে গেল চোখা ফলা।
তাতেও থামল না দানব। ঝাড়া দিয়ে বুক থেকে বল্লম খুলে ফেলে আবার লাফ দিল।
আবার বল্লম বাড়িয়ে দিল মিরাটো। বাঘের বুকে আবার গাথল বল্লম। বল্লমের আরেক ফলা মাটিতে ঠেকিয়ে ছেড়ে দিল সে, লাফিয়ে সরে এল।
চাপে ধনুকের মত বাকা হয়ে গেল বল্লম। কিন্তু খুলল না। সোজা হলো, বাঘের পিঠ ফুড়ে বেরিয়ে গেল। এবার কাবু হয়ে এল জাগুয়ার, কিন্তু থামল না। মিরাটোর গলা সই করে লাফ দিল, ধরতে পারলে এক কামড়ে ছিঁড়ে ফেলবে কণ্ঠনালী।
সরে গেল মিরাটো।
বুক-পিঠ এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছে বল্লম, নড়াচড়া আর বেশি করতে পারছে না জাগুয়ার। থাবা আটকে যাচ্ছে, বল্লমের জন্যে নড়াতে পারছে না।
বন্দুকে গুলি ভরে ফেলেছে আবার কিশোর। বাঘের হৃৎপিণ্ড সই করে গুলি করল।
পড়ে গেল জাগুয়ার। তবু থামল না। এগোনোর চেষ্টা করল।
মাথায় গুলি করল মুসা।
এইবার শেষ হলো। লুটিয়ে পড়ল বাঘ।
কিন্তু জয়ের আনন্দে হাসতে পারল না কিশোর। তার মনে হলো, পরাজয়ই হয়েছে তাদের। জাগুয়ারকে জ্যান্ত ধরতে পারেনি।
.
০৮.
ইনভিয়ানরা জাগুয়ারের মাংসও খেলো। মুসা এক টুকরো মুখে দিয়েই ফেলে দিল। কেমন শক্ত শক্ত রবারের মত, দাঁত দিয়ে কাটতে কষ্ট হয়, বাজে স্বাদ। ইনডিয়ানরাও ভাল বলছে না, তবু খাচ্ছে। ওদের বিশ্বাস, এই মাংস খেলে। জাগুয়ারের মতই সাহসী আর শক্তিশালী হয়ে উঠবে।
সেদিন রাতে গর্তের ওপর আবার ফাঁস পেতে রাখা হলো।
কিন্তু জাগুয়ার এল না।
ঠিক আছে, পরদিন সকালে বলল কিশোর, বাঘ না এলে আমরাই বাঘের কাছে যাব।
বেরিয়ে পড়ল সবাই।
বনের ভেতরে জাগুয়ারের পায়ের তাজা দাগ খুঁজে বের করল মিরাটো।
অনুসরণ করে চলে এল একটা পাহাড়ের গোড়ায়। একটা গুহার ভেতরে গিয়ে ঢুকেছে ছাপ।
বন্দুক হাতে টিপে টিপে গুহামুখের কাছে পৌঁছল কিশোর। সাবধানে উঁকি দিল ভেতরে। অন্ধকার। কিছুই চোখে পড়ল না। কোন নড়াচড়া নেই, সাড়া নেই, এমনকি নিঃশ্বাসের শব্দও নেই। মাংশাসী জীবের গায়ের বোটকা তীব্র গন্ধ রয়েছে। বাতাসে, তারমানে আছে জাগুয়ার। সুড়ঙ্গের অনেক ভেতরে।
সঙ্গে করে শক্ত জাল আনা হয়েছে, ম্যানিলা দড়ি দিয়ে তৈরি। গর্তের মুখে বিছিয়ে দেয়া হলো জাল।
চারপাশে খুঁটি গেঁথে তাতে আটকানো হলো এমনভাবে, উল্টোদিক থেকে যাতে সামান্য গুতো লাগলেই খুলে যায়।
জালের চার কোণায় চারটে লুপ রয়েছে, সেগুলোর ভেতর দিয়ে ঢুকিয়ে দেয়া হলো লম্বা মোটা একটা দড়ি। দড়ির দুটো প্রান্তই ঘুরিয়ে আনা হলো একটা গাছের। ডালের ওপর দিয়ে।
জাল ঠেলে বেরোনোর চেষ্টা করবে জাগুয়ার। তাতে তার শরীরটা ঢুকে যাবে। জালের মধ্যে। দড়ি ধরে হ্যাঁচকা টান দিলেই তখন জালের চারকোণা এক হয়ে যাবে, আটকা পড়বে জীবটা। শূন্যে টেনে তোলা হবে তখন ওটাকে গাছের ডালে ঝুলিয়ে রাখা হবে, যতক্ষণ না তেজ কমে। তারপর খাঁচা এনে দরজা ওপরের দিকে করে জালসহ তার ভেতর নামিয়ে দেয়া হবে জাগুয়ারটাকে। দরজা বন্ধ করে জাল ছাড়ানোর ব্যবস্থা হবে, সেটা যেভাবেই হোক করা যাবে, পরের কথা পরে। আগেতো ধরা পড়ুক।
সারাক্ষণই চারজন করে পাহারা রইল দড়ির মাথার কাছে। চার ঘণ্টা পর পর পাহারা বদল হলো।
সারাটা দিন অপেক্ষা করে আছে সবাই। জাগুয়াবের দেখা নেই। বেলা। ডোবার সময় উত্তেজনা চরমে পৌঁছল। এই বুঝি নড়ে ওঠে জাল, মাথা দেখা যায়।
দিবাচরদের বাসায় ফেরার সময় হলো, জেগে উঠল নিশাচরেরা। ধীরে ধীরে শুরু হলো তাদের জারিগান, কিন্তু তার সঙ্গে সুর মেলাল না জাগুয়ার।
এতক্ষণ তো ভেতরে থাকার কথা নয়! হতাশ হলো কিশোর। নেই নাকি? . অন্য কোন মুখ আছে সুড়ঙ্গের, সেদিক দিয়ে বেরিয়ে গেছে।