আরও কাছে বাজ পড়ল আরেকবার।
উত্তেজনায়, ভয়ে চোখের পাতা ফেলতে ভুলে গেছে যেন ওরী। ঝোপের দিকে চেয়ে আছে। তাই জানোয়ারটাকে দেখতে পেল না। প্রচণ্ড গর্জনে চমকে উঠল। ঝড় উঠল যেন গর্তের মধ্যে।
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল কিশোর। পড়েছে! পড়েছে!
গর্তের কাছে দৌড়ে এল ওরা! চেঁচামেচি শুনে ক্যাম্প থেকে ইনডিয়ানরাও ছুটে এল।
ঘূর্ণিঝড় বইছে যেন গর্তের ভেতরে। পাতা, লতা আর ধুলো উড়ছে। মাঝে মাঝে কালো-হলুদ রঙের ঝিলিক।
গর্তের বেশি কাছে যাওয়ার সাহস নেই কারও।
সবাই খুশি, জিবা ছাড়া। মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে আছে ডুমুর গাছটার গোড়ায়।
টানটান হয়ে গেছে দড়ি, ডালটা যেন তুফানে দুলছে। নুয়ে যাচ্ছে বার বার, ঝটকা দিয়ে সোজা হচ্ছে। বোঝা গেল, ফাসে আটকেছে বাঘ।
ফাঁদে তো পড়ল, এখন আসল কাজটা বাকি। বাঘকে খাঁচায় পোরা। কি করে। ঢোকাবে? গর্জনের দাপটেই বুকের ভেতরে হাতুড়ির বাড়ি পড়ছে সবার।
খাঁচাটা গর্তের একেবারে কিনারে নিয়ে যেতে বলল কিশোর। গাছে চড়ে ডাল। থেকে দড়িটা খুলে আনল। তারপর খাঁচার খোলা দরজা দিয়ে দড়ির মাথা ঢুকিয়ে উল্টো দিকের দেয়ালের ফাঁক দিয়ে বের করল। এখন সবাই মিলে টানলে উঠে আসবে বাঘ, দরজা দিয়ে ঢুকতে বাধ্য হবে। শুনতে খুব সহজ, কিন্তু যারা করছে, তারা বুঝতে পারছে কাজটা কতখানি কঠিন।
খাঁচার পেছনে ঝোপে লুকিয়ে দড়ি ধরে টান দিল সবাই, জিবা বাদে। সে এসবে নেই, সাফ মানা করে দিয়েছে। দাঁড়িয়ে ছিল, এখন বসে পড়েছে ডুমুর গাছের গোড়ায়। কাজ তো করছেই না, টিটকারি দিচ্ছে, ভয় দেখাচ্ছে। ইনডিয়ানদের। ধমক দিয়েও চুপ করানো যাচ্ছে না তাকে।
চমৎকার ফন্দি করেছে কিশোর। উঠে এল জাগুয়ার। খাঁচার দরজায় মাথা ঢোকাল, আরেকটু হলেই ঢুকে যাবে শরীরটা। যারা টানছে তাদেরকে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু মুখ ভোরাতেই চোখ পড়ল জিবার ওপর।
আর যায় কোথায়? ধরেই নিল, সমস্ত শয়তানীর মূলে ওই দু-পেয়ে জীবটা। জ্বলে উঠল হলুদ চোখ। ভয়ঙ্কর গর্জন করে হ্যাঁচকা টান মারল দড়িতে।
এতগুলো লোক মিলেও আর ধরে রাখতে পারল না, সরসর করে বেরিয়ে গেল। দড়ি, ঘষা লেগে তাদের হাতের চামড়া ছিলল।
আতঙ্কে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে গাছে উঠতে শুরু করল জিবা।
মাথা ঠাণ্ডা থাকলে হয়তো এই ভুল করত না। কারণ, তার জানা আছে। জাগুয়ার গাছেও চড়তে পারে।
গুলি করো! গুলি করো! চেঁচাচ্ছে জিবা।
মুসার রাইফেল আর কিশোরের বন্দুক সঙ্গেই রয়েছে। কিন্তু গুলি করল না। কেউ। এত কষ্ট করে ডেকে এনে ধরার পর মারতে চায় না বাঘটাকে।
ওপরে উঠে চলেছে জিবা। ভাবছে উঁচুতে সরু ডাল, ভেঙে পড়ার ভয়ে ওখানে। উঠবে না বাঘ। তা-ই হয়তো করত, কিন্তু জিবার কপাল খারাপ, সে নিজেই। যেতে পারল না ওখানে। ঘন পাতার আড়ালে রয়েছে বোলতার বাসা, না দেখে। হাত দিয়ে বসল তাতে।
আর যায় কোথায়। কার এত্তবড় সাহস! বোলতার বাসায় হাত দেয়! রাগে বনবন করে উঠল ওগুলো। চোখের পলকে এসে ছেকে ধরল জিবাকে। বিচার আচার-শুনানীর বালাই নেই, শরীরের যেখানে খোলা পেল সেখানেই হুল ফুটিয়ে দিল।
বাবাগো! মাগো! বলে চেঁচিয়েও রেহাই পেল না মিরাটো।
ওদিকে উঠে আসছে জাগুয়ার। বেয়াড়াপনা আজ ঘুচিয়েই ছাড়বে তার।
নিচ থেকে দেখছে দর্শকরা। গাছের বাকলে নখ বিধিয়ে ইঞ্চি ইঞ্চি করে উঠে। যাচ্ছে বাঘটা। শরীর লম্বা করে মিশিয়ে ফেলেছে ডালের সঙ্গে, অপূর্ব সুন্দর একটা কালো-হলুদ মোটা সাপ যেন।
কিন্তু জাগুয়ারের হাঁ করা মুখের দিকে তাকিয়ে কোন সৌন্দর্য দেখতে পেল না জিবা। তার মনে হলো, নরকের ইবলিসের দুটো চোখ, হাঁ করা চোয়ালে ধারাল দাঁতগুলো শয়তানের দাঁত। মুহূর্ত পরেই তাকে কেটে টুকরো টুকরো করবে। চেঁচিয়ে বন কাঁপাচ্ছে না আর বাঘ, গম্ভীর গোঁ গোঁ করছে কেবল। জিবার মনে হলো, ব্যাটা হাসছে। বাগে পেয়ে বেড়াল যেমন ইঁদুরকে খেলায়, টিগ্রে বদমাশটাও তা-ই করছে।
হা-হা করে হাসতে ইচ্ছে করছে মুসার। জাগুয়ারের ভয়ে পারছে না। যদি শব্দ শুনে তাদের দিকে নজর দেয় আবার? জিবার শাস্তিতে খুব খুশি সে। উচিত শিক্ষা হয়েছে বেয়াদবটার। গুলি সে অবশ্যই করবে জাগুয়ারকে, তবে শেষ মুহূর্তে। যখন দেখবে জিবার ঘাড় ভাঙতে উদ্যত হয়েছে। ততক্ষণ চালিয়ে যাক বোলতারা।
কিন্তু কিশোর আর চুপ থাকল না। জাগুয়ারের গলায় আটকে আছে এখনও ফাঁস, দড়ির আরেক মাথা ঝুলছে। তাড়াতাড়ি গিয়ে সেই মাথাটা গাছের সঙ্গে শক্ত করে বেধে দিল সে।
পাগলের মত দুই হাতে বোলতা তাড়াচ্ছে জিবা।
আরও কয়েক ইঞ্চি উঠে দড়িতে টান পড়ল। হঠাৎ বাধা পেয়ে রেগে গেল। আবার জাগুয়ার, প্রচণ্ড গর্জন করে হ্যাঁচকা টান মারল। টানাটানি আর ঘষাঘষিতে দড়ির একটা জায়গা নরম হয়ে গেছে, পট করে গেল ছিঁড়ে।
এবার ভয় পেল কিশোর।
হাসি উধাও হয়ে গেল মুসার মুখ থেকে।
রবিন হতবাক।
ইনডিয়ানরা বোবা।
আর বুঝি বাঁচানো গেল না জিবাকে!
বিপদটা জিবাও বুঝতে পেরেছে। কেঁদে ফেলল সে। বোলতার পরোয়া আর করল না, উঠে যেতে লাগল ওপরে। হুলের যন্ত্রণা এক সময় কমবে, কিন্তু জাগুয়ারে ধরলে নির্ঘাত মৃত্যু।
জাশুয়ারটা নাছোড়বান্দা। উঠে যাচ্ছে।
হাতের টিপ ভাল না কিশোরের, বন্দুকের গুলি বাঘের গায়ে না লেগে যদি জিবার গায়ে লাগে?–এই ভয়ে ট্রিগার টিপতে সাহস পাচ্ছে না।