কাণ্ডটা করল কি। রবিনের দিকে ফিরল মুসা। নথি. তোমার বই কি বলে? সত্যি লেজের বাড়ি দিয়ে মাছ ডেকে আনল?
নিজের চোখেই তো দেখলাম, রবিন বলল। অবিশ্বাস করি কি করে? দাঁড়াও, আসছি। টলডোর ভেতরে গিয়ে একটা বই নিয়ে এল। নেচারালিস্ট ওয়ালেসের লেখা। বইয়ের পাতা উল্টে এক জায়গায় এসে থামল। এই যে, লিখেছেন : ব্রাজিলের জঙ্গলের সবচেয়ে বুর্ত জীব জাগুয়ার। যে কোন পাখি কিংবা জানোয়ারের ডাক নকল করতে পারে। ডেকে কাছে নিয়ে আসে। তারপর ধরে ধরে খায়। মাছ ধরে আড়ত কৌশলে লেজ দিয়ে পানিতে বাড়ি মারে। ফল কিংবা পোক পড়েছে ভেবে ওপরে উ আনে মাছ, ধারে ফেলে তখন জাগুয়ার। কাছিমও ধরতে পারে। শুধু তাই না, পাতি কাতাশকেও আক্রমণ করে বসে। একজন। প্রত্যক্ষদর্শী আমাকে জানিয়েছে, একটা শুভশকে মেরে ফেলতেও নাকি দেখেছে সে। গরুর ওজনের প্রাণীকে সহজেই টেনে তুলেছে ডাঙায়।
খাইছে! কিশোরের দিকে ফিরল মুসা। এই জীবকে ধরতে চাও? পাগল!
আগ্রহ দেখাল জিবা, সিনর কি টিগ্রে ধরতে চাও?
হ্যাঁ, কিশোর আশা করল, জিবা তাকে সাহায্য করতে চায়।
কিন্তু টিগ্রে তো ধরতে পারবে না।
কেন?
বিশ-তিরিশজন দরকার। আমরা আছি নয়জন, তা-ও তিনজন… মুসার ওপর চোখ পড়তে শুধরে নিল, দু-জন ছেলেমানুষ।
ভুল বলেনি জিবা, মনে মনে স্বীকার করল কিশোর। কিন্তু যে যা-ই বলুক, টিগ্রে না ধরে ছাড়বে না সে। গায়ের জোরে না পারলে বুদ্ধির জোরে ধরবে।
দুপুরে নৌকা তীরে ভেড়ানোর নির্দেশ দিল সে। খাওয়া সেরে নিয়ে কাজে লাগিয়ে দিল লোকজনকে। জিবা প্রতিবাদ জানালে বলল, দেখো, বাঘ না ধরে আমি যাচ্ছি না এখান থেকে। যত দিন লাগে লাগুক।
সোজা, শক্ত দেখে বাঁশ কাটা হলো। সেগুলোকে কাঁচা লিয়ানা লতা দিয়ে বেধে মজবুত খাঁচা তৈরি হলো। একটামাত্র দরজা রাখা হলো খাঁচার।
ইচ্ছে করেই ছোট রেখেছে খাঁচাটা কিশোর। যাতে ভেতরে ঢুকে নড়াচড়ার বিশেষ জায়গা না পায় বাঘ, তাহলে ভাঙতে পারবে না। চার ফুট উঁচু আর চার ফুট পাশে, লম্বা দশ ফুট।
নদীতে কোন পথে পানি খেতে যায় বাঘ, খুঁজে বের করল মিরাটো।
পথের ওপর একটা গর্ত খুঁজতে বলল কিশোর, সবার সঙ্গে সে-ও হাত লাগাল। জিবাকে দিয়ে কোন কাজই করানো যাচ্ছে না। একটা গাছের তলে বসে বকবক করছে আপনমনে।
গর্ত খোঁড়া শেষ হলো। ছয় ফুট গভীর, ব্যাসও প্রায় ছয় ফুট। কয়েকটা বাঁশ কেটে টুকরো করে বিছানো হলো গর্তের ওপরে। লতাপাতা দিয়ে এমনভাবে ঢেকে দেয়া হলো, যাতে গর্ত আছে বোঝা না যায়। মোটা দড়ির ফাঁস বানিয়ে তার ওপর রাখল কিশোর, সেটাকেও ঘাসপাতা দিয়ে ঢাকা হলো। গর্তের প্রায় ওপরে এসে ঝুঁকেছে বিশাল এক ডুমুর গাছের ডাল। দড়ির আরেক মাথা ওই ডালে বেঁধে দিল সে। বাঘ এসে গর্তে পড়লে ওই ফাসের মধ্যখান দিয়ে পড়বে, আটকে যাবে।
খাঁচাটা এনে রাখা হলো গর্তের কাছে, ঝোপের ভেতর লুকিয়ে। বাঘ ধরা পড়লেই যাতে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে ঢোকানো যায় খাঁচায়। তাই
কোন কাজ হবে না, নাকমুখ কুঁচকে বলল জিবা।
কান দিল না কেউ।
ক্যাম্পে ফিরে অপেক্ষায় রইল সবাই।
দিন শেষ। রাতের শুরুতেই গর্তের কাছে চেঁচামেচি শোনা গেল। গিয়ে দেখা গেল, বাঘ নয়, ঝামেলা পাকানোর ওস্তাদ তাপির। হতাশ হলো কিশোর। একটা আছে, আরেকটা নিয়ে কি করবে? নৌকায় জায়গাও নেই। বাধ্য হয়ে ছেড়ে দিতে হলো।
ভারি জানোয়ারটাকে টেনে তুলে ফাঁসমুক্ত করে গর্তের মুখে আবার লতাপাতা বিছাতে, ফাঁস পাততে, দুই ঘণ্টা লেগে গেল। অযথা সময় নষ্ট আর পরিশ্রম।
আবার ফিরে এল ওরা ক্যাম্পে। আবার অপেক্ষার পালা। সময় যাচ্ছে। বাঘের সাড়াশব্দ নেই।
মিরাটো, কিশোর বলল। বাঘ তো নেই মনে হচ্ছে। অন্য জানোয়ার এসে খামোকা ঝামেলা করবে। কি করি?
বাঘকে ডেকে আনতে হবে, শান্তকণ্ঠে বলল মিরাটো।
কিশোর, রবিন এমনকি মুসাও জানে কাজটা অসম্ভব নয়। ভারতের জঙ্গলে আসল বাঘকেও ডেকে এনে গুলি করে মেরেছেন জিম করবেট আর কেনেথ অ্যাণ্ডারসনের মত শিকারীরা। করবেট চিতাবাঘকেও ডেকে এনেছেন। কিশোর। জানে, উত্তর আমেরিকার মুজ হরিণকেও ডেকে আনা যায়। আনে শিকারীরা।
পোঁটলা থেকে একটা শিঙ্গা বের করল মিরাটো। রওনা হলো গর্তের দিকে। সঙ্গে চলল তিন গোয়েন্দা!
গর্তের কাছ থেকে খানিক দূরে নদীর দিকে পেছন করে পথের পাশে ঝোপে ঢুকল মিরাটো। তার পাশে বসল তিন কিশোর।
শিঙ্গায় ফুঁ দিল মিরাটো। নিখুঁত জাগুয়ারের ডাক, কাশি দিয়ে শুরু হলো, ভারি গর্জন শেষ হলো কয়েকবার খোত খোত করে।
স্তব্ধ হয়ে গেল সারা বন, নিমেষে চুপ হয়ে গেল সমস্ত ডাকাডাকি। ভয়ে অবশ হয়ে গেছে যেন সব। কিন্তু বাঘ সাড়া দিল না।
ধারেকাছে নেই, নিচুকণ্ঠে বলল কিশোর।
খানিক বিরতি দিয়ে দিয়ে সারা রাতই ডাকল মিরাটো।
ভোরের একটু আগে আশা প্রায় ছেড়ে দিয়েছে ওরা, এই সময় শোনা গেল কাশি। নদীর অন্য পাড়ে।
জায়গা বদলাল চারজনে। গর্তের উল্টো ধারে আরেকটা ঝোপের ভেতরে। ঢুকল, মুখ এখন নদীর দিকে। আলো ফুটছে। কালো নদীর পানি ধূসর হয়েছে, কিন্তু বনের তলায় আগের মতই অন্ধকার।
ডাকল আবার মিরাটো। সঙ্গে সঙ্গে জবাব এল। আবার ডাক। আবার। জবাব। এগিয়ে আসছে বাঘ। আর মাইলখানেক দূরেও হবে না।
খানিকক্ষণ আর সাড়া নেই। হঠাৎ যেন একেবারে কানের কাছে বাজ পড়ল। নদী পেরিয়ে এসেছে জাগুয়ার। আর ডাকার সাহস হলো না মিরাটোর। চুপ করে রইল।