ঘামছে কিশোর। বন্দুকে হাত। এমন করে তাকিয়ে আছে কেন বাঘটা? মানুষখেকো?
কাজ শেষ করে আবার শুয়ে পড়ল লোকটা।
বাঘটা শুয়ে পড়ল না। না, মানুষখেকো বোধহয় না। লোকটা নড়াচড়া করাতে সতর্ক হয়েছিল।
হাঁপ ছাড়ল কিশোর।
হঠাৎ পেছনের জঙ্গলে পিরের তীক্ষ্ণ নাকি ডাক শোনা গেল। চকিতে সেদিকে ঘুরে গেল হলুদ-কালো বিশাল মাথাটা। নিঃশব্দে উঠে ঝোপের ভেতরে, হারিয়ে গেল বাঘ।
অপেক্ষা করছে কিশোর।
এক সঙ্গে হুইসেল বাজল এবং বাজ পড়ল যেন বনের ভেতরে। পিরের তীক্ষ্ণ আর্তনাদ, আর বাঘের ভীষণ গর্জন। কয়েক সেকেণ্ড হুটোপুটির পর থেমে গেল। সব শব্দ।
ক্যাম্পের সবাই জেগে গেছে।
বাঘে ধরল না! হ্যামক থেকে ভেসে এল মুসার কম্পিত কণ্ঠ।
ভাগ্যিস আগুন জ্বলছে। বলল রবিন।
হ্যামকে থেকেই জানাল কিশোর, কি হয়েছে।
এরপর আবার ঘুমাতে দেরি হলো সকলেরই।
সকালে নাস্তা সেরে বেরোল অভিযাত্রীরা। বাঘের পায়ের ছাপ ধরে এগোল।
স্যুপ-প্লেটের সমান বড় একেকটা ছাপ, গোল। পিরিচের কিনারে আঙুলের ছাপ স্পষ্ট, কিন্তু নখের দাগ নেই। হাটার সময় নখ ভেতরে লুকিয়ে রাখে জাগুয়ার, বেড়ালের মত।
দেখে মনে হয়, মুসা বলল, পায়ে মখমলের প্যাড লাগানো।
ওই প্যাড লাগানো থাবারই থাপ্পড় খেয়ে বড় বড় ষাড়ের মেরুদণ্ড ভেঙে যায়, মিরাটো বলল।
আগে আগে হাঁটছে সে। সে না থাকলে এই ছাপ অনুসরণ করে এগোতে পারত না তিন গোয়েন্দা, বুঝতই না কিছু।
তাপিরকে যেখানে আক্রমণ করেছে বাঘটা, সে-জায়গাটায় এসে দাঁড়াল ওরা। ঝড় বয়ে গেছে যেন। ঝোপের ডাল ভাঙা, লতা ছেঁড়া, পাতা ছেঁড়া, খানিকটা জায়গার ঘাস দলে-মুচড়ে রয়েছে। রক্ত লেগে আছে।
কিশোর আশা করেছিল, তাপিরের মড়ির অবশিষ্টটা দেখতে পাবে। হতাশ হলো। কিছুই নেই। তারমানে জাগুয়ার আর ফিরে আসবে না এখানে। শিকার কাহিনীতে পড়েছে, মডির কিছু হাড়গোড় বাকি থাকলেও খাওয়ার জন্যে ফিরে আসে বাঘ। কাছাকাছি ওত পেতে থাকে তখন শিকারী। ফাঁদ পেতে। জানোয়ারটাকে ধরে, কিংবা গুলি করে মারে। ধরার আশায়ই দলবল নিয়ে এসেছে। কিশোর, লাভ হলো না।
দেখো, হাত তুলল রবিন। নিশ্চয় ইনডিয়ানরা গেছে।
ইনডিয়ান না, মিরাটো মাথা নাড়ল। বাঘ।
এত চওড়া! কটা বাঘ গেছে?
একটাই, মুচকি হাসল মিরাটো। তাপির টেনে নিয়ে গেছে।
অবিশ্বাস্য কাণ্ড। ঝোপের মাঝে তিন-চার ফুট চওড়া একটা পথ করে রেখেছে, রোলার চালানো হয়েছে যেন ওখান দিয়ে।
এত ভারিটাকে টেনে নিল? চোখের সামনে দেখছে আলামত, তবু মুসার বিশ্বাস হচ্ছে না।
ওই পথ ধরে এগোল ওরা। সাবধানে খুব আস্তে আস্তে পা ফেলছে। যে কোন মুহূর্তে মড়ির সামনে পড়তে পারে, হয়তো বা বাঘেরও।
কিন্তু শেষ আর হতে চায় না পথ। মাইলখানেক পেরিয়ে নদীর পাড়ে এসে পড়ল ওরা। চিহ্ন শেষ।
ভুরু কুঁচকে তাকাল কিশোর। নদীটা কয়েক মাইল চওড়া।
ওই নদী পেরিয়েছে। গালে আঙুল রাখল রবিন।
পেরোলে অবাক হব না, মিরাটো বলল। এর চেয়ে বেশি ভার নিয়ে সাঁতরে নদী পেরোতে দেখেছি টিগ্রেকে। তবে মনে হয়, এই বাঘটা তা করেনি। পানিতে নেমে শিকারকে খানিকদূর টেনে নিয়ে গিয়ে এপাডেই আবার কোথাও উঠেছে। এদিকেও হতে পারে, ওদিকেও। হয়তো তার বৌ-বাচ্চা আছে, তাদেরকে নিয়ে খাবে।
এ-রকম ঘটনার কথা কিশোর পড়েছে। ঘোড়া মেরে ঘন ঝোপঝাড়ের মধ্যে। দিয়ে জাগুয়ারকে টেনে নিয়ে যেতে দেখেছেন একজন বিখ্যাত ব্রাজিলিয়ান শিকারী জেনারেল রনডন। শিকারীর চোখকে ফাঁকি দেয়ার জন্যে নদীতে নেমে কিনারের পানি দিয়ে টেনে নিয়ে গেছে খানিক দূর, যাতে চিহ্ন না থাকে। তারপর আবার উঠে পানির ধারে একটা ঘন ঝোপে লুকিয়েছে ঘোড়াটাকে।
তাপির নিয়ে যেখানে নদীতে নেমেছে জাগুয়ার তার আশেপাশে কিছুদূর। খোঁজাখুজি করল মিরাটো। কিন্তু আর কোন চিহ্ন চোখে পড়ল না। বিড়বিড় করল, নদীর ওপারেই চলে গেল নাকি?
ক্যাম্পে ফেরার পথে জাগুয়ারের ক্ষমতার আরও নজির দেখা গেল। মাটি থেকে ছয়-সাত ফুট উঁচুতে বিশাল এক গাছের বাকল ফালাফালা। মিরাটো জানাল, ওখানে নখ ধার করেছে টিগ্রে। নখের আচড়ের কয়েক ফুট নিচে খসখসে বাকল মসৃণ হয়ে গেছে। জানোয়ারটার পেটের ঘষায় হয়েছে ওরকম।
.
০৭.
নৌকা চলেছে।
বড় বজরার গলুইয়ের কাছে বসে আছে রবিন। হঠাৎ হাত তুলল সে। কি ব্যাপার? দেখতে এল অন্য দুই গোয়েন্দা
ইশারায় দেখাল রবিন।
নদীর পাড়ে এক জায়গার ঝোপঝাড় সামান্য ফাঁকা। একটা মরা গাছ পানিতে পড়ে আছে। তার ওপর বসে আছে একটা জাগুয়ার। মুখ আরেক দিকে ফেরানো, মাছ ধরায় ব্যস্ত সে।
লেজ দিয়ে পানিতে বাড়ি মারছে, পানিতে ফল কিংবা বড় পোকা পড়লে যেমন হয়, তেমনি আওয়াজ করছে।
হঠাৎ থাবা মারল জাগুয়ার। পানির ওপরে তুলতেই দেখা গেল নখে গেঁথে। ছটফট করছে একটা মাছ।
আরাম করে চিবিয়ে মাছটাকে খেলো সে। আবার লেজ নামাতে গিয়ে কি মনে করে মুখ ফেরাল। অলস ভঙ্গিতে দেখল নৌকা আর যাত্রীদের। মনে মনে। বোধহয় বলল, নাহ, আর হবে না। গেল আমার মাছ ধরা। আস্তে করে উঠে গাছ। থেকে লাফিয়ে নামল মাটিতে। আরেকবার নৌকার দিকে চেয়ে, রাজকীয় চালে হেলেদুলে হেঁটে ঢুকে গেল বনে।
দাঁত বের করে হাসছে মিরাটো। খুব চালাক, এমনভাবে বলল, যেন ওটা তার পোষা বাঘ।