ফল গাছেরও অভাব নেই। আম, অ্যাভোকাডো, কোকা, রুটিফল গাছে ধরে আছে রাশি রাশি ফল। কলার ঝাড়ের প্রায় প্রতিটি গাছেই কলা। খানিকটা খোলা জায়গায় ঘন সবুজ হাতিঘাস, তারপরে শুরু হয়েছে মূল্যবান গাছের জঙ্গল। লোহাকাঠ, মেহগনি, সিভার ও রবার গাছের সীমা-সংখ্যা নেই। আট-দশতলা বাড়ির সমান উঁচু ব্রাজিল-বাদাম আর মাখন-বাদাম গাছে যে কত বাদাম ধরেছে, আন্দাজ করা মুশকিল। আর আছে ছড়ানো বিশাল ডুমুর গাছ। আরও কিছু গাছ আছে, যেগুলো থেকে তেল বের করা যায়, সেই তেল কারখানার কাজে লাগে।
ইদানীং ইউনাইটেড স্টেটস আগ্রহ দেখাচ্ছে আমাজনের দিকে, বলল ল্যানসো। আমাজন ইনস্টিটিউট গড়েছে। বিভিন্ন বিষয়ে অভিজ্ঞ ডজন ডজন। বিশেষজ্ঞ পাঠাচ্ছে আমাজন বেসিনে গবেষণা চালানোর জন্যে। কয়েকজন আমার ফাম দেখে গেছে। উৎসাহ দিয়ে গেছে ওরা।
ল্যানসোর হাত ধরল কিশোর। আমাকে মাপ করবেন, স্যার, আপনাকে চলে যেতে বলেছি বলে। এখন আমারই থাকতে ইচ্ছে করছে। চলি, গুড বাই।
বজরা-বহরে ফিরে এল অভিযাত্রীরা। নৌকা ভাসাল।
বুয়েনো ল্যানসোর অজান্তে তার গান-র্যাকে একটা রিভলভার, আর ২৭০ উইনচেস্টার রাইফেলটা রেখে দিয়ে এসেছে কিশোর। কয়েক বাক্স গুলি আর কিছু কাপড়-চোপড়ও রেখে এসেছে। বিছানার ওপর মানিব্যাগটা পাবে ল্যানসো, তবে এখন আর সেটা খালি নয়, তাতে কিছু ভলার রয়েছে।
দিয়েছে যতটা, এনেছে তার চেয়ে অনেক বেশি–অসাধারণ ওই শিক্ষকের দুর্জয় সাহস আর প্রচণ্ড আত্মবিশ্বাসের খানিকটা, যা ছাড়া টিকতে পারবে না এই ভয়াবহ আমাজনে।
০৬.
দিন যায়, ভ্যাম্পের আর কোন সাড়া নেই। কিন্তু কিশোর জানে, তাদের আগে আগে চলেছে ডাকাতের দল। এখনও হয়তো বুঝতে পারেনি, যাদেরকে খুজছে, তারা রয়েছে পেছনে। যেই বুঝবে, পথে কোথাও ঘাপটি মেরে থাকবে। বজরা বহর কাছাকাছি হলেই দখলের চেষ্টা চালাবে।
রোজই কিছু না কিছু নতুন যাত্রী যোগ হচ্ছে বজরা-বহরে। একটা টকটকে লাল আইবিস পাখি, একটা গোলাপী শুনবিল, একটা সোনালি কনিউর, একটা কিউরেসো আর একটা কক অভ দা রক ধরল। সব কটাই পোষ মানল।
জানোয়ার ধরার নেশায় পেয়েছে কিশোরকে। এত ধরেও কিছুতেই সন্তুষ্ট হতে পারছে না।
আসল দুটোকেই ধরতে পারলাম না এখনও, একদিন বলল সে। অ্যানাকোন্তা আর টিগ্রে। মিরাটো, কিভাবে ধরি, বলো তো?
তরুণ ইনডিয়ানের ওপর বিশ্বাস জন্মে গেছে তিন গোয়েন্দার। পছন্দ করেছে তাকে। সে-ও পছন্দ করেছে ওদেরকে। অবসর সময়ে ঘন্টার পর ঘন্টা টলডোর ছাতে বসে গোয়েন্দাদের লিঙগুয়া জেরাল (জেনারেল ল্যাংগোয়েজ) শেখায় সে। আমাজনে প্রতিটি ইনডিয়ান গোত্রেরই নিজস্ব ভাষা রয়েছে। এছাড়া একটা সাধারণ ভাষা চালু আছে, যেটা আমাজন বেসিনের সবাই জানে, এখানকার ইনটারন্যাশ নাল ভাষা বলা চলে। বাইরের যারা ওখানে বেড়াতে কিংবা থাকতে যায়, ওই ভাষা শেখা তাদের জন্যে অতি জরুরী। কারণ বেশিরভাগ ইনডিয়ানই পর্তুগীজ জানে না, আর ইংরেজি প্রায় কেউই জানে না।
শিমি এল-টিগ্রের দেখা পাবে,বলল মিরাটে। বাঘের রাজ্যে চলে এসেছি।
এল-টিগ্রে কিংবা জাওয়ারের চেয়ে বাঘ বলাটাই সহজ। তাই না? মূসা বলল।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। বাঘই তো ওটা।
বাঘের সঙ্গে আবার কুস্তি করতে যেয়ো না,হেসে মুসাকে বলল রবিন। সাপ আর পিঁপড়েখেকো মনে কোরো না টিগ্রেকে। এক থাবায় টারজানগিরি খতম করে। দেবে।
হ্যাঁ, একমত হলো কিশোর। ভীষণ একরোখা। হার্টে গুলি খেয়েও নাকি থামে না, শিকারীর দিকে তেড়ে আসে। সহজে দম বেরোতে চায় না।
ঠিকই বলেছে মিরাটো, বাঘের রাজ্যে ঢুকেছে ওরা। রাতে প্রায়ই শোনা যায়। গর্জন। কাছ থেকে ভয়ঙ্কর শোনায়। বাতাসে কাপন তোলে সে-শব্দ, সেই সঙ্গে বুকের ভেতরেও।
একদিন রাতে দেখা দিল টিগ্রে।
হ্যামকে শুয়ে আছে কিশোর, মুখ ফিরাতেই দেখে বাঘ। বিশ ফুট দূরে। তাকে দেখতে পায়নি বাঘটা, আগুনের কুণ্ডের দিকে চেয়ে আছে কৌতূহলী চোখে। বড় বড় হলুদ চোখ দুটো আগুনের মতই জ্বলছে। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বেড়ালের মত লম্বা হয়ে শুয়ে পড়ল, বেড়ালের মতই হা করে জিভ বের করে হাই তুলল।
বাঘের এই হঠাৎ আগমন আশা করেনি কিশোর। খাঁচা রেডি হয়নি, জাল তৈরি নেই, লোকজন সব ঘুমাচ্ছে; কেউ নৌকায়, কেউ তার কাছাকাছি-হ্যামকে কিংবা মাটিতে।
ওদের ডাকতে গেলে সতর্ক হয়ে যাবে বাঘটা।
কিশোরের পাশে রাখা আছে বন্দুক, কিন্তু এত সুন্দর জীবটাকে গুলি করতে চায় না সে। বিশ ফুট দূরে বাঘ শুয়ে আছে, ঘুমাতেও পারবে না। খুব তাড়াতাড়ি বাঘটারওনড়ার ইচ্ছে নেই, বোঝা যায়।
আগুনে কাঠ ফেলতে উঠল একজন ইনডিয়ান।
ঝট করে উঠে বসল বাঘ।
বন্দুকে হাত চলে গেল কিশোরের। কিন্তু তেমন বিপদে না পড়লে গুলি করবে। না। একে তো এই হ্যামকে থেকে নিশানা ঠিক রাখতে পারবে না, তার ওপর এক গুলি খেয়ে হয়তো কিছুই হবে না বাঘের, মাঝখান থেকে শান্ত বেড়ালটা উন্মত্ত শয়তান হয়ে যাবে।
হ্যাঁ, এখন তো দেখে শান্ত বেড়ালই মনে হচ্ছে ওটাকে। কিশোর জানে, সব। জানোয়ারই মানুষকে এড়িয়ে চলে। নিতান্ত বাধ্য কিংবা কোণঠাসা না হলে সহজে আক্রমণ করে না। জাগুয়ারও করে না। কিন্তু মানুষখেকো হলে আলাদা কথা।
ঘুমের ঘোরে কাঠ ফেলছে লোকটা। কাছে বসে আছে ভয়ঙ্কর এক জীব, তাকে লক্ষ্য করছে, খেয়ালই নেই তার।