ঝট করে চোখ তুলে তাকাল তিনজনে।
ছাত দেখা যাচ্ছে না, অনেক উঁচু আর অন্ধকার। সেই অন্ধকার থেকে নেমে আসছে পাখিটা। বিশাল এক কালো বাজ পাখি। ছো মারার জন্যে নামছে, গতি বাড়ছে দ্রুত। তীক্ষ্ণ চিৎকার করে উঠল, বাঁকা ভীষণ ঠোঁট ফাঁক, ভেতরে চোখা লাল জিভ, চোখে তীব্র ঘৃণা। ধারাল নখ বাড়িয়ে ওদেরকে ছিঁড়তে আসছে।
চার
খাইছে! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। ঝাঁপ দিয়ে পড়ল মেঝেতে।
তার দেখাদেখি রবিন আর কিশোরও শুয়ে পড়ল।
থামল না পাখিটা। ভীষণ গতিতে নেমে এল। থেমে গেল ওদের মাথার এক ফুট ওপরে এসে। তিন গোয়েন্দাকে অবাক করে দিয়ে ঝুলে রইল ওখানেই। চিৎকারও থেমে গেছে।
আস্তে মাথা কাত করে ওপর দিকে তাকাল কিশোর। উঠে বসল। ভয় দূর হয়ে গেল চেহারা থেকে, সে-জায়গা দখল করল হাসি।
ওঠো, ডাকল সে। জ্যান্ত পাখি না ওটা।
কী? ভয়ে ভয়ে মাথা তুলল মুসা। চোখে অবিশ্বাস।
রবিনের অবস্থাও তারই মত।
সরু তামার তারে ঝুলছে পাখিটা।
খেলনা, ছুঁয়ে দেখে বলল কিশোর। বেশির ভাগই প্ল্যাস্টিক।
আল্লারে, কোন্ পাগলের পাল্লায় পড়লাম! মুখ বিকৃত করে ফেলল মুসা।
বিশাল ঘরের অন্ধকার থেকে ভেসে এল খসখসে অট্টহাসি। মাথার ওপর দপ করে জ্বলে উঠল একাধিক উজ্জ্বল আলো।
লম্বা, রোগাটে একজন মানুষ চেয়ে আছেন ওদের দিকে, পরনে কালো ঢোলা আলখেল্লার মত ওভারকোট। খাট করে ছাঁটা চুল, তামাটে লাল।
রহস্যের দুর্গে স্বাগতম, ভারি খনখনে গলায় বললেন তিনি, মুসার মনে হলো কবর থেকে উঠে এসেছে জিন্দালাশ।
সামনের দিকে বাঁকা হয়ে গেল তার শরীর, প্রবল হাসিতে দুলছে। হাসতে হাসতে কেশে ফেললেন, তারপরও কাশি চলল কিছুক্ষণ, দমকে দমকে।
রসিকতা-বোধ না ছাই! নিচু কণ্ঠে বিড়বিড় করল মুসা। বদ্ধ উন্মাদ!
হাসি আর কাশির জন্যে মুসার কথা কানে গেল না বোধহয় তাঁর। ধীরে ধীরে সোজা হলেন, চোখের কোণে পানি জমেছে। রোভার মারটিন বলছি। পাখিটাকে সরিয়ে দিচ্ছি, নইলে যদি ঠোকর মারে।
উঠে দাঁড়াল তিন গোয়েন্দা।
হাসিমুখে তাদের কাছে এগিয়ে এলেন মারটিন। হুক থেকে খুলে নিলেন পাখিটা।
ছাতের দিকে চেয়ে কিশোরও হাসল। সঙ্গীদের বলল, সরু লাইন। বানিয়ে তার ওপর দিয়ে চালায়। ইলেকট্রিক খেলনা ট্রেনের মত।
ওপর দিকে চেয়ে মুসা আর রবিনও দেখল বিশেষ কায়দায় তৈরি লাইন। সামান্য ঢালু। ওটার ওপর দিয়ে পাখিটা পিছলে নামে বলে গতি বাড়ে। লাইন শেষ হলে ছিটকে নেমে আসে, আবছা অন্ধকারে মনে হয় ছোঁ মারতে আসছে।
ট্রেন অনেক ভাল, মুসা বলল। মানুষকে ভয় দেখায় না।
হাসছেন মারটিন। খুব বোকা বানিয়েছি, না? সরি। বিচিত্র খেলনা বানানো আমার হবি। হাত তুলে দেখালেন, ওই যে আমার কারখানা।
ঘরের এক ধারে ওঅর্কশপ, নানারকম যন্ত্রপাতি, কাঠ, তারের জাল, প্ল্যাস্টিকের টুকরো, তারের বাণ্ডিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
পাখিটা একটা টেবিলে রাখলেন মারটিন। তারপর, কি মনে করে? কণ্ঠস্বর পাল্টে গেছে, একেবারে স্বাভাবিক, তারমানে ইচ্ছে। করেই তখন স্বর বিকৃত করে কথা বলছিলেন।
একটা কার্ড বের করে দিল কিশোর। এটা দেখলেই বুঝবেন।
তিন গোয়েন্দার কার্ডটা পড়লেন তিনি, তারপর হাসিমুখে ফিরিয়ে দিলেন। হারানো কুকুরের খোঁজ নিতে এসেছ তো?
হ্যাঁ, বলল কিশোর। মিস্টার জোনসের আইরিশ সেটারটা পাওয়া যাচ্ছে না। ভাবছি, সী-সাইডের অন্যান্য কুকুর নিখোঁজের সঙ্গে এর সম্পর্ক আছে।
থাকতে পারে, বললেন মারটিন। রেডিওর খবরে শুনেছি। জোনস তো মাঝে মাঝেই থাকে না, শুনেছি, গত দু-তিন মাসও নাকি ছিল না। গত হপ্তায় ফিরেছে। কুত্তাটা হারিয়েছে তাহলে। খুঁজে বের করতে পারবে তো?
চেষ্টা করব। ভাবলাম, মিস্টার, জোনসের প্রতিবেশীদের সঙ্গে আলাপ করলে জরুরী তথ্য পাওয়া যাবে, তাই এসেছি। মিস্টার হেরিঙের ওখানেও গিয়েছিলাম। চেনেন নিশ্চয়?
হাসলেন মারটিন। এখানে কে তাকে না চেনে? যা বদমেজাজ। বন্দুক দেখিয়েছে?
দেখিয়েছেন। তবে সেফটি ক্যাচ অন করা ছিল। শাসিয়েছেন, আবার যদি তার বাড়িতে কুকুর ঢোকে, গুলি করে মারবেন। কুকুর দু চোখে দেখতে পারেন না ভদ্রলোক।
শুধু কুকুর কেন, কোন কিছুই দেখতে পারে না। মানুষও না।
আপনি পারেন বলেও তো মনে হয় না, ফস করে বলে বসল মুসা, অযথা ভয় পেয়েছে বলে রাগ লাগছে এখন। মানুষকে এভাবে ভয় দেখানোর কোন মানে হয়?
ভুল করলে। মানুষকে আমি খুবই পছন্দ করি। কিন্তু যখন তখন অবাঞ্ছিত লোক ঢুকে পড়ে তো, শান্তিতে কাজ করতে দেয় না, তাই এই বিশেষ ব্যবস্থা। ফেরিওলা আর কোম্পানির এজেন্টরা হচ্ছে সবচেয়ে বিরক্তিকর। তোমরা ভয় পেয়েছ, না?
দুর্বল হার্ট হলে এতক্ষণে তিনটে কফিনের অর্ডার দিতে হত আপনাকে।
হেসে উঠলেন মারটিন। খুব মজার মজার কথা বলল যা হোক। হ্যাঁ, আমি জাতে ইঞ্জিনিয়ার। ছোটখাটো আবিষ্কারও করেছি। আগেই বলেছি, খেলনা বানানো আমার হবি, তবে ওগুলো ক্ষতিকর। নয়।
কুকুরের কথা কিছু বলুন, আগের কথার খেই ধরল কিশোর। কিছু জানেন-টানেন?
মাথা নাড়লেন মারটিন। সরি। রেডিওতেই যা শুনেছি। মালিকদের সঙ্গে গিয়ে আলাপ করে দেখতে পারো।
মিস্টার জোনসের সঙ্গে অবশ্য করেছি। কিন্তু তিনি যে কথা বললেন, বিশ্বাস করাই শক্ত।
কি কথা?
ঠোঁট কামড়াল কিশোর। বলা কি উচিত হবে?