সহকারীদের কথায় বিশেষ কান দিল না কিশোর। এমনও হতে পারে, রাগ দেখানোটা একটা অভিনয়। কুকুরগুলোর খবর হয়তো তাঁর জানা।
কথাটা কিন্তু মন্দ বলনি! একমত হলো রবিন।
এভাবে আর হুট করে কোথাও ঢুকব না। বুঝে-শুনে, তারপর।
কি বলছে ও? কিশোরকে দেখিয়ে রবিনকে জিজ্ঞেস করল মুসা।
জবাবটা কিশোরই দিল। হাত তুলে আরেকটা বাড়ি দেখিয়ে বলল, মিস্টার জোনসের আরেক প্রতিবেশী। একজনের সঙ্গে তো মোলাকাত করলাম, বাকি আরেকজন। তাঁর মেজাজটা জানাই বা বাকি রাখি কেন? মিস্টার রোভার মারটিনকেও কয়েকটা প্রশ্ন করব।
বুক সমান উঁচু ধাতব একটা গেট পথরোধ করল ওদের। তার ওপর দিয়ে বিরাট বাড়িটার দিকে তাকাল ওরা।
ভালই তো মনে হচ্ছে, রবিন বলল। কামান-টামান নেই।
শটগান আছে কিনা দেখো! খুব সাবধানে কয়েক ইঞ্চি পাশে সরল মুসা। ওপর আর নিচতলার সবগুলো জানালায় নজর বোলাল।
কই, কাউকে দেখা যাচ্ছে না। মিস্টার মারটিন বাড়ি নেই নাকি?
আগে বাড়ল কিশোর। গেলেই দেখা যাবে… থেমে গেল সে, হাঁ করে চেয়ে আছে গেটের পাল্লার দিকে। নিঃশব্দে খুলে যাচ্ছে।
খাইছে! ককিয়ে উঠল মুসা, জাদুকরের বাড়ি…
আরে, না, বাতাসে খুলেছে, রবিন বলল।
মাথা নাড়ল কিশোর। ডানার মত করে দু-পাশে দু-হাত ছড়িয়ে দিয়ে রবিন আর মুসাকে আটকাল, পিছিয়ে যেতে বলে নিজেও পিছিয়ে এল। আপনা-আপনি বন্ধ হয়ে গেল গেট।
আবার সামনে এগোল কিশোর। খুলে গেল গেট।
ইলেকট্রনিকের জাদু, বলল সে। এয়ারপোর্ট, সুপারমার্কেট, অফিস-পাড়ার বড় বড় বিল্ডিংগুলোতে দেখনি?
তা দেখেছি, মুসা বলল। কিন্তু কারও বাড়িতে এই প্রথম…
এতেই প্রমাণ হচ্ছে কুসংস্কার কিংবা ভূতপ্রেতে বিশ্বাস করেন না। মিস্টার মারটিন। ড্রাগনের ব্যাপারটা হেসেই উড়িয়ে দেবেন।
তাহলে আর গিয়ে লাভ কি?
এসেছি যখন দেখেই যাই না, ভেতরে ইলেকট্রনিকের আরও জাদু থাকতে পারে।
গেটের ভেতরে পা রাখল ওরা। পথের ধারে লন, ঠিক মাঝখানে বড় একটা সূর্যঘড়ি, চমৎকার তার অলঙ্করণ। সামনে মাথার ওপরে।
একটা ফুলের জাফরি, তাতে অনেকগুলো ফুলগাছ, ফুল ফুটে রয়েছে।
সামনে এগোল ওরা। পেছনে নিঃশব্দে বন্ধ হয়ে গেল গেট। জাফরির তলা দিয়ে পথ। ওটার নিচ দিয়ে এগোতেই হঠাৎ যেন ভেঙে খসে পড়ল জাফরি। এক সঙ্গে পিছিয়ে আসতে গিয়ে একে অন্যের গায়ে ধাক্কা লাগাল ওরা। পড়ে যাচ্ছিল রবিন, খপ করে তার হাত চেপে ধরল মুসা।
আসলে পুরো জাফরিটা খসে পড়েনি। মস্ত এক মাচার চারধারে ধাতব রেলিঙ দিয়ে ঘেরা, চারপাশের ওই রেলিঙগুলো খসে পড়েছে চারদিক থেকে, মাচাটা আর তাতে লাগানো ফুলগাছগুলো রয়ে গেছে তেমনি। শিকের একটা খাঁচায় বন্দি হলো যেন ছেলেরা, মাথার ওপরে ফুলের কেয়ারি।
আজব রসিকতা। শুকনো ঠোঁট চাটল কিশোর। পোর্টকালিস দেখে আইডিয়াটা পেয়েছে বোধহয়।
সেটা আবার কি জিনিস? জানতে চাইল মুসা।
ভারি লোহার শিকের কপাট। পুরানো দুর্গের দরজার ওপরে শেকল দিয়ে ঝোলানো থাকত। শেকল ছেড়ে দিলেই ওপর থেকে ঝমঝম করে নেমে এসে পথ বন্ধ করে দিত।
বইয়ে ছবি দেখেছি, রবিন বলল। বেশির ভাগ পুরানো দুর্গেরই সদর দরজায় লাগানো থাকত ওই জিনিস। পাল্লাও থাকত দরজায়। শত্রুরা পাল্লা ভেঙে ফেললে তাদেরকে ঠেকানোর শেষ চেষ্টা হিসেবে ছেড়ে দেয়া হত পোর্টকালিস, পাল্লার চেয়ে অনেক শক্ত।
আমরা কি দুর্গে ঢুকছি নাকি? হাত ওল্টাল মুসা।
অদ্ভুত একটা হিসহিস শব্দ তুলে আবার উঠে যেতে শুরু করল রেলিঙগুলো। মাচার চারধারে জায়গামত গিয়ে বসে গেল আবার।
পরস্পরের দিকে তাকাল ছেলেরা।
রসিকতা, বিড়বিড় করল কিশোর! চলো।
কিশোরের হাত চেপে ধরল মুসা। যাওয়াটা কি ঠিক হচ্ছে? এই দুর্গে আমাদেরকে ঢুকতে দিতে চায় না বোধহয়।
হাসল কিশোর। ভয় পেলে? পাওয়ারই কথা অবশ্য। অটোমেটিক গেট, জাফরির ইলেকট্রনিক কনট্রোলড রেলিঙ। বিজ্ঞানের জাদুকর মিস্টার মারটিন। দেখা না করে যাচ্ছি না আমি।
এগোল কিশোর। পেছনে ভয়ে ভয়ে পা ফেলতে ফেলতে চলল তার দুই সহকারী।
সদর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে সঙ্গীদের দিকে চেয়ে হাসল গোয়েন্দাপ্রধান। তারমানে, দেখলে তো, আর কিছু হলো না। বেল বাজানোর সুইচে আঙুল রাখল।
আঁউ! করে চিৎকার দিয়ে ছিটকে সরে এল কিশোর। হাত ঝাড়ছে। সুইচেও কারিগরি করে রেখেছে। কারেন্ট!
আগেই বলেছি তোমাকে, মুখ গোমড়া করে বলল মুসা। আমাদের ঢুকতে দিতে চায় না। তা-ও জোরাজুরি করছ। যথেষ্ট হয়েছে, চলো এবার। মিস্টার মারটিনের সঙ্গে দেখা করা আর লাগবে না।
আসলে আমাদের পরীক্ষা করছে। ফেরার কোন ইচ্ছেই নেই কিশোরের। ভয় দেখিয়ে তাড়াতে চাইছে। শেষ পর্যন্ত যদি থাকতে পারি, দেখা করবে এসে।
কিশোরের কথার জবাবেই যেন মৃদু ক্লিক করে উঠে নিঃশব্দে খুলে যেতে শুরু করল দরজা।
দারুণ! রবিন বলল। পুরো বাড়িটাকে ইলেকট্রনিকসের জালে ঘিরে রেখেছে।
সাবধানে ভেতরে পা রাখল ওরা। আবছা অন্ধকার, বড় বেশি নীরব।
কাউকে দেখা গেল না। কেশে গলা পরিষ্কার করে অদৃশ্য কারও উদ্দেশ্যে জোরে জোরে বলল কিশোর, গুড ডে, মিস্টার মারটিন। আমরা তিন গোয়েন্দা। আপনার প্রতিবেশী মিস্টার জোনসের হয়ে কথা বলতে এসেছি। আসব, স্যার?
জবাব নেই।
তারপর, অতি মৃদু একটা খসখস শোনা গেল মাথার ওপরে। ডানা ঝাঁপটানোর আওয়াজ। নেমে আসছে।