কিন্তু দেখা গেল, কিশোরের পেছনে মুসাই গেল আগে, তারপর রবিন।
সরু পথ পেরিয়ে গেট খুলে ঢুকল মিস্টার হেরিঙের সীমানায়। জোনসের বাড়িতে যেমন অযত্ন, এখানে তেমনি অতিযত্ব। সব কিছু ছিমছাম, পরিচ্ছন্ন। পাতাবাহারের একটা পাতাও এদিক-ওদিক হয়ে নেই, সমান করে ছাঁটা, সমান উঁচু প্রতিটি গাছ, ঝকঝকে সবুজ লন, নিয়মিত ঘাস ছাঁটা হয়, একটা মরা ডাল নেই বাগানের কোন গাছে। ফুলের বিছানাগুলো দেখার মত। বাড়ির মালিক পরিষ্কার থাকতে পছন্দ করেন।
বেল টিপল কিশোর।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গে খুলে গেল দরজা। মাঝারি উচ্চতার বলিষ্ঠ একজন লোক কড়া চোখে তাকালেন ওদের দিকে। কি চাই? বাজখাই কণ্ঠ।
মাপ করবেন, স্যার, বিনয়ে বিগলিত গোয়েন্দাপ্রধান। রাস্তার ওপারে আপনার পড়শীর সঙ্গে দেখা করে এলাম, মিস্টার জোনসের কথা বলছি। তার কুকুরটা হারিয়ে গেছে। আপনি কিছু জানেন কিনা। জিজ্ঞেস করতে এলাম।
চোখের পাতা কাছাকাছি হলো ভদ্রলোকের, ঘন ভুরুজোড়া কাছাকাছি হয়ে আবার সরে গেল। ঠোঁটে ঠোঁট চেপে বসল।
কুত্তাটা তাহলে হারিয়েছে? খুব ভাল। আর না পাওয়া গেলেই খুশি। যত্তসব পাগল-ছাগল, কুত্তা পালে, হুহ্!
জ্বলে উঠল তার চোখ, মুঠো হলো আঙুল।
বাপরে, ঘুসি মারতে আসবে নাকি! ভয় পেয়ে গেল মুসা।
জোর করে চেহারাটা স্বাভাবিক রাখল কিশোর। বুকের মধ্যে। কাঁপুনি শুরু হয়ে গেছে তারও। আপনি যে কুকুর দেখতে পারেন না, নিশ্চয় যথেষ্ট কারণ আছে। কি করেছে ওরা যদি বলেন…
কি করেছে, না; কি করেছে! বলি, কি করেনি? সব সময় যা করে তাই করেছে। সারা রাত হউ হউ করে চেঁচায়, চিল্কারের জ্বালায় ঘুমাগো যায় না। আমার ফুলের বেড় মাড়িয়ে শেষ করে, লন নষ্ট করে, ডাস্টবিন উল্টে ফেলে ময়লা-আবর্জনা সব পথের ওপর ছড়িয়ে দেয়। আরও শুনবে?
তাই নাকি? বলল কিশোের। মালিকদের আরও সাবধান হওয়া উচিত। আমরা, স্যার, এই এলাকায় এই প্রথম এসেছি, মিস্টার জোনস কুকুরটা খুঁজে দিতে ডেকেছেন। তাঁকে বলব আপনার অসুবিধের কথা। তার কুকুর আপনার জিনিস নষ্ট করে থাকলে ক্ষতিপূরণ দিতে তিনি বাধ্য। কুকুরের জন্যে সব কিছুই তিনি করতে রাজি…
বাধা দিলেন হেরিঙ, রাজি, না; রাজি! কুকুরের জন্যে সব কিছুই করবেন! একটু দাঁড়াও, দেখাচ্ছি, ভেতরে চলে গেলেন তিনি।
দাঁড়িয়ে আছে তিন গোয়েন্দা, ভদ্রলোকের ব্যবহারে অবাক।
ঝটকা দিয়ে খুলে গেল আবার দরজা। ফিরে এসেছেন হেরিঙ। হাতে শটগান।
ওরা কেউ কিছু করবে না। যা করার এরপর থেকে আমাকেই করতে হবে। জানো কি করব? ফেটে পড়ল বাজখাই কণ্ঠ। কুত্তাটা আবার এলে দুটো নলই খালি করব হারামীটার পাছায়। কুত্তার ছায়া আমার বাড়িতে দেখলেই গুলি করব! অনেক সহ্য করেছি, আর না!
বন্দুকের বাঁট কাঁধে ঠেকালেন তিনি। নিশানা করলেন তিন গোয়েন্দাকে, এমন ভঙ্গি, যেন ওরাই কুত্তার ছায়া।
তিন
ট্রিগারে আঙুলের চাপ বাড়ছে। কর্কশ কণ্ঠে ধমকে উঠলেন হেরিঙ, নিশানা খুব ভাল আমার, মিস করি না। আর কিছু বলার আছে। তোমাদের?
দুরুদুরু করছে মুসার বুক। তার মনে হলো নলের কালো ফুটো দুটো তার দিকেই চেয়ে আছে।
অস্বস্তিতে মাথা নাড়ল কিশোর। না, স্যার, আর কিছু জানার নেই। ডিসটার্ব করেছি, সরি। চলি।
শক্ত হলো হেরিঙের ঠোঁট। হ্যাঁ, যাও, জোনসকে বলে দিও, মিষ্টি কথায় কোন কাজ হবে না। আর যেন খাতির করার জন্যে কাউকে না পাঠায় আমার কাছে।
তিনি, স্যার, পাঠাননি। আমরাই…
খোঁচা মারার ভঙ্গিতে সামনের দিকে বন্দুকের নলটা ঠেলে দিলেন। হেরিঙ। গুহ করে থুতু ফেললেন মাটিতে।
ধীরে ধীরে পিছাতে শুরু করল ছেলেরা।
আহ্, দেখে হাঁটো! কানা নাকি! ধমকে উঠলেন হেরিঙ। লন মাড়িয়ে দিচ্ছ তো!
আড়চোখে দুই বন্ধুর দিকে তাকাল কিশোর। ভয় পাচ্ছে ওরা। পাগলের পাল্লায় পড়েছে ভাবছে। ঘুরতেও যেন ভয় পাচ্ছে, যদি গুলি। করে বসেন।
ফিসফিস করে মুসাকে বলল রবিন, আস্তে ঘোরো। তাড়াহুড়ো কোরো না।
মাথা সামান্য একটু কাত করে সায় জানাল মুসা। সাবধানে ঘুরল। দু-জনে। ছোটার জন্যে অস্থির হয়ে উঠেছে, কিন্তু ছুটছে না।
বোম ফাটল যেন পেছনে।
ভীষণ চমকে গেল মুসা। ধড়াস করে উঠল বুক। পরমুহূর্তে বুঝল না, বন্দুকের গুলি নয়, দরজার পাল্লা লাগানোর শব্দ।
জোরে নিঃশ্বাস ফেলে ঘুরে তাকাল কিশোর। হেরিঙকে দেখা যাচ্ছে না।
অর্ধেক পথ এসে আরেকবার ফিরল। এখনও দরজা বন্ধ।
দ্রুত গেটের বাইরে বেরিয়ে এল ওরা।
উফ্ফ্! হাঁপাতে হাঁপাতে বলল রবিন, বড় বাঁচা বেঁচেছি!
ঠিকই বলেছ, মুসা বলল, আমরা একটু এদিক-ওদিক করলেই দিত গুলি মেরে!
না, মারত না, মাথা নাড়ল কিশোর। বোল্ট লক করা ছিল, সেফ পজিশন।
বোকা হয়ে গেল দুই সহকারী গোয়েন্দা।
অ, এ জন্যেই, মাথা দোলাল মুসা, এ জন্যেই ভয় পাওনি তুমি! তাই তো বলি…
আমাদের গুলি করার জন্যে বন্দুক আনেননি, কিশোর বলল।
রাগ দেখাতে, ভয় দেখাতে এনেছিলেন। কুকুরের কথা বলেই ভুল করেছি।
গেছি কুকুরের কথা জিজ্ঞেস করতে, বলল মুসা, আর কি করতাম?
আনমনে ঠোঁট কামড়াল কিশোর। আবার গেলে সাবধানে কথা বলতে হবে মিস্টার হেরিঙের সঙ্গে।
আবার? মাথা নাড়ল মুসা। না, ভাই, আমি এর মধ্যে নেই। যেতে হলে তুমি যাও। আমি আর যাচ্ছি না ওখানে।
আমিও না, মানা করে দিল রবিন।