কিন্তু গতরাতে যা শুনেছি, আমার সৃষ্টি করা শব্দের সঙ্গে তার কোন মিল নেই। উঁচু পর্দার তীক্ষ্ণ একধরনের খসখসে শব্দ, যেন শ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে জানোয়ারটার, সেই সঙ্গে কাশি। আসলে, বলে। ঠিক বোঝানো যাবে না শব্দটা কেমন।
শুনলাম, আপনার বাড়ির নিচে একটা গুহা আছে? জিজ্ঞেস করল কিশোর। ছোট, না বড়? ড্রাগনের মত কোন জানোয়ারের জায়গা হবে?
তা হবে। একটা না, অনেক গুহা আছে এখানে, মাটির তলায় সুড়ঙ্গের জাল রয়েছে বলা যেতে পারে। উত্তর-দক্ষিণে অনেক দূর পর্যন্ত ছড়িয়ে গেছে। এককালে জলদস্যু, চোরাচালানি আর ডাকাতের আড্ডা ছিল ওসব জায়গায়। বছর কয়েক আগে ভূমিকম্পে একটা পাহাড়ের চূড়া ভেঙে গিয়ে ভূমিধস নামে, বেশ কিছু সুড়ঙ্গ আর গুহা বুজে যায়, হ্যাঁগিটিজ পয়েন্টের কাছে। তবে এখনও অনেক গুহা আর সুড়ঙ্গ আগের মতই আছে।
হুম্। আনমনে মাথা দোলাল কিশোর। অনেক বছর ধরেই তো আছেন এখানে, কিন্তু এই প্রথম ড্রাগন দেখলেন। তাই না?
মাথা ঝাঁকালেন বৃদ্ধ, হাসলেন। একবারই যথেষ্ট, আর দেখতে চাই না। কুকুরটা না হারালে এটাকেও দেখতাম না। পাইরেটকে খুঁজতে গিয়েই তো চোখে পড়ল।
কুকুরটার কথা কিছু বলুন। রবিন, নোটবই অর পেন্সিল নাও, কিশোর বলল।
ছেলেদের খাঁটি পেশাদারী ভাবভঙ্গি দেখে মুচকি হাসলেন পরিচালক। বললেন, গত দু-মাস ছিলাম না এখানে। ছবি বানাই না বটে, কিন্তু সিনেমা-জগৎ থেকে পুরোপুরি বিদায়ও নিতে পারিনি। প্রতি বছর বড় বড় যত চলচ্চিত্র উৎসব হয়, সবগুলোতে যোগ দিই; ইউরোপে যাই, দুনিয়ার বড় বড় অনেক শহরে যাই। এবারও গিয়েছিলাম। রোম, ভেনিস, প্যারিস, লণ্ডন আর বুদাপেস্ট সফর করেছি, উৎসবে যোগ দিয়েছি, পুরানো বন্ধুদের সঙ্গে দেখাসাক্ষাৎ করেছি।
আমি বাইরে গেলে পাইরেটকে একটা কুকুরের খোঁয়াড়ে রেখে যাই, কাছেই খোয়াড়টা। গত হপ্তায় ফিরে এসে ওখান থেকে নিয়ে এসেছিলাম ওকে। খুব সুন্দর কুকুর, আইরিশ সেটার। দিনে বেঁধে রাখি, রাতে ছেড়ে দিই। মাঝে মাঝেই বাড়ির সীমানার বাইরে চলে যেত পাইরেট, খানিকক্ষণ পরেই ফিরে আসত। কাল রাতে বেরিয়ে আর ফিরল না। তিন বছর ধরে আছে, কোনদিন এ রকম হয়নি। ফোন করলাম খোয়াড়ে। ভাবলাম, দু-মাসের অভ্যাস, বন্ধুদের সঙ্গে দেখা করতে গেছে। কিন্তু ওখানে যায়নি কুকুরটা। নিজেই খুঁজতে বেরোলাম তখন। ড্রাগনটাকে দেখলাম।
সৈকতে যাননি নিশ্চয়? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
মাথা নাড়লেন বৃদ্ধ। না। কি যে খারাপ লেগেছে না। সারাজীবন লোর্ককে ভয় দেখিয়েছি, আতঙ্কিত করেছি, তাদের ভয় দেখে হেসেছি, মজা পেয়েছি। নিজে ভয় পাওয়ার পর বুঝলাম, ওদের কেমন লেগেছে…ভয়ানক ড্রাগনটা পাইরেটকে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছে ভাবলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়…ওটাকে দেখে ভাবলাম, আমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে…কি, বিশ্বাস হচ্ছে?
প্রশ্নটা এড়িয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর, সকালে আপনার বন্ধুকে ফোন করলেন, তাই না?
আবার ভুরু আর কপাল মুছলেন বৃদ্ধ। ডেভিস আমার খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু। রহস্যের জগতে অনেক উদ্ভট ঘটনা ঘটে, জানা আছে তার। তাই প্রথমেই তার কথা মনে পড়ল। ভাবলাম, কোন সাহায্য করলে সে-ই। করতে পারবে। ভুল করিনি। বিশ্বাস না করলে তোমাদের পাঠাত না। তোমাদের ওপর ভরসা করে সে, বুঝতে পারছি।
আপনি করছেন?
করছি। ডেভিস আমার চেয়ে অনেক বেশি খুঁতখুঁতে। সে যাদের ওপর আস্থা রাখতে পারে, তাদের ওপর আমিও রাখতে পারি চোখ
থ্যাংক ইউ, মিস্টার জোনস, খুশি হলো কিশোর। এই শহরে আরও কুকুর হারিয়েছে, জানেন? গত এক হপ্তায় পাঁচটা, আপনারটা ছাড়াই।
আবার মাথা ঝাঁকালেন বৃদ্ধ। শুনেছি, তবে পাইরেট নিখোঁজ হওয়ার পর। আগে জানলে ওকে ছেড়ে রাখতাম না।
যাদের হারিয়েছে, তাদের কারও সঙ্গে কথা বলেছেন?
না। ভয়েই যাইনি। মুখ ফসকে যদি ড্রাগনের কথাটা বেরিয়ে যায়!
এখানে সবারই কুকুর আছে?
হাসলেন জোনস। সবার নেই। রাস্তার ওপারে মিস্টার হেরিঙের নেই। আমার বাড়ির ডানে আরেক প্রতিবেশী আছে, রোভার মারটিন, তারও নেই। আর তেমন কাউকে চিনি না। নিরিবিলি একা থাকা পছন্দ আমার। বই, ছবি, আর পাইরেটকে নিয়ে কাটাই। এখানে কারও সঙ্গে বিশেষ আলাপ নেই। দেখা হলে, কেমন আছেন, ভাল, ব্যস।
উঠল কিশোর। যাই এখন। কিছু জানতে পারলে জানাব। আপনাকে।
তিন গোয়েন্দার সঙ্গে আবার হাত মেলালেন জোনস। গেটের কাছে, এগিয়ে দিয়ে গেলেন ওদেরকে। বাইরে বেরিয়ে পাল্লাটা বন্ধ করে দিল। কিশোর। ওপরের হুক লাগিয়ে দিল।
হেসে বলল মুসা, ভয় পাচ্ছ? ড্রাগন বেরোবে ভাবছ বাড়ির ভেতর থেকে?
যা গেট, ড্রাগনের বাচ্চাকেও ঠেকাতে পারবে কিনা সন্দেহ, বলল কিশোর। এমনি তুলে দিলাম। ভদ্রতা।
নির্জন পথের দিকে তাকাল মুসা। ঘড়ি দেখল। বোরিস আসছে না কেন? এই এলাকা ছাড়তে পারলে যেন বাঁচে।
এত তাড়াতাড়ি আসার কথা না। আরও দেরি হবে।
রাস্তা পেরোতে শুরু করল কিশোর।
যাচ্ছ কোথায়? জিজ্ঞেস করল রবিন।
মিস্টার হেরিঙের সঙ্গে দেখা করব। তারপর যাব মারটিনের ওখানে। এমন একটা জায়গায় থাকে অথচ কুত্তা পালে না, তারা কেমন লোক, দেখার আগ্রহ নেই তোমাদের?
না, নেই, দু-হাত নাড়ল মুসা। এখানে সব পাগলদের বাস। একজন দেখেছে ড্রাগন, আরেকজন হয়তো বলবে আরব্য উপন্যাসের চেরাগওয়ালা দৈত্য দেখেছে। আমার গিয়ে কাজ নেই।