আগে আগে চলল কিশোর। পাতাবাহারের বেড়ার চাপে জড়সড় হয়ে আছে যেন কাঠের গেটটা। ঠেলা দিতেই পাল্লা খুলে গেল। পামের জঙ্গলের ভেতর দিয়ে ঘুরে ঘুরে চলে গেছে পথ। নারকেলের ঝাড়, ঘন ঝোঁপ আর বুনো ফুলের আড়াল থেকে উঁকি দিচ্ছে বিবর্ণ হলদে ইটের একটা বাড়ি। অযত্নে হয়েছে এই অবস্থা, বোঝাই যায়। সাগর থেকে হু-হুঁ বাতাস এসে সরসরানি তুলছে নারকেল শাখায়, বুনো ফুল আর লতাকে নড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে। বাড়িটা সাগরের একেবারে কিনারে।
সদর দরজায় এসে ঘণ্টা বাজাল কিশোর।
দরজা খুলে দিলেন মিস্টার জোনস। বেঁটে, মোটাসোটা মানুষ। বিষণ্ণ বড় বড় বাদামী চোখ, ঘন ভুরু, সাদা চুল, মুখের রোদে পোড়া চামড়ায় বয়েসের ভাজ।
এসো এসো, হাত বাড়িয়ে দিলেন তিনি। ডেভিস পাঠিয়েছে তো? তিন গোয়েন্দা?
হ্যাঁ, স্যার, পকেট থেকে কার্ড বের করে দিল কিশোর। আমি কিশোর পাশা..ও মুসা আমান, আর ও রবিন মিলফোর্ড।
সন্তুষ্ট হয়ে মাথা ঝাঁকালেন জোনস, কার্ডটা পকেটে রাখলেন। এসো। স্টাড়িতে গিয়ে কথা বলি।
রোদ ঝলমলে মস্ত এক খোলামেলা ঘরে ওদের নিয়ে এলেন। তিনি।
হাঁ হয়ে গেল ছেলেরা। বিরাট ঘরের দেয়ালে মেঝে থেকে ছাত পর্যন্ত খালি ছবি আর ছবি, এক তিল জায়গা নেই। নানা রকম বিখ্যাত চিত্রকর্ম, বড় বড় অভিনেতা-অভিনেত্রীর সই করা ফ্রেমে বাঁধানো ছবি, আর সিনেমা জগতের কিছু বিশেষ অনুষ্ঠানের দৃশ্য।
পড়ার টেবিলটায় টেবিল-টেনিস খেলা যাবে, এত বড়; কাগজ, বই আর কাঠের ছোটবড় খোদাইকর্মে বোঝাই। শেলফ ও শো কেসগুলোতেও ঠাই নেই, অদ্ভুত সব মূর্তি, পুতুল, খেলনায় ভর্তি। দুটো জিনিস কিশোরের দৃষ্টি আকর্ষণ করল: দুটোই মূর্তি-একটা ডাইনীর, মধ্যযুগে তৈরি হয়েছিল; আরেকটা আফ্রিকান, এক কালো দেবতার, কুৎসিত, নিষ্ঠুর চেহারা।
ছেলেদের চেয়ার দেখিয়ে বসতে বললেন বৃদ্ধ। ঘুরে গিয়ে বসলেন। ডেস্কের ওপাশে সিংহাসনের মত এক চেয়ারে। আমি কি কাজ করতাম নিশ্চয় বলেছে ডেভিস?
হ্যাঁ, কিশোর জানাল। চিত্রপরিচালক।
ছিলাম, হেসে বললেন জোনস। অনেক বছর আগেই রিটায়ার করেছি। ডেভিস তখন নতুন পরিচালক হয়েছে। ও তো এখন বিখ্যাত লোক, আমার সময়ে আমিও ছিলাম। আমাদের দুজনের কাজের ধারা প্রায় এক। দু-জনেই রহস্য-রোমাঞ্চের ভক্ত, তবে মানসিকতার দিক থেকে কিছুটা আলাদা। ও বাস্তব জিনিস পছন্দ করে, আমি অবাস্তব।
বুঝলাম না, স্যার।
বাস্তবে যা ঘটে, ঘটতে পারে, সে-সব কাহিনী নিয়ে ছবি তৈরি করে ডেভিস। আমি করতাম অতিকল্পিত কাহিনী নিয়ে, ফ্যান্টাসি। ড্রাগনের কথা পুলিশের কাছে বলতে পারলাম না তো এ জন্যেই। উদ্ভট, অবাস্তব কাহিনী নিয়ে ছবি করেছি সারা জীবন, ভয়াবহ দুঃস্বপ্নেও যা কল্পনা করা যায় না। আমার ছবিতে থাকত ভয়ানক সব দৈত্য-দানব, মায়ানেকড়ে, ভূতপ্রেত, ডাইনী…সোজা কথা, আমার স্পেশালিটি ছিল হরর ফিল্ম।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। হ্যাঁ, স্যার, আপনার নাম শুনেছি। এবার চলচ্চিত্র উৎসবে আপনার একটা ফিল্মও দেখেছি। রোম খাড়া হয়ে গিয়েছিল।
থ্যাংক ইউ, বললেন বৃদ্ধ। তাহলে বুঝতেই পারছ, কেন পুলিশের কাছে যাইনি। দীর্ঘ দিন কোন ছবি বানাই না, নতুন দর্শকেরা অনেকেই আমার নাম জানে না, পুরানোরা ভুলে গেছে। কিছু বোকা লোক ভাববে, ড্রাগনের গল্প ফেঁদে নতুন করে পাবলিসিটি করতে চাইছি আমি, আবার সিনেমায় ঢোকার জন্যে।
কিন্তু আমি জানি, আমার কাজ শেষ, দিন শেষ। এখন কিছু বানালে চলবে না, ফ্লপ করবে, নেবে না আধুনিক দর্শক। এই বয়েসে নতুন কিছু যে বানাব, তা-ও সম্ভব না। সেই পুরানোই হয়ে যাবে। তার চেয়ে নতুনদের জন্যে পথ ছেড়ে দিয়ে সরে এসেছি। অনেক কাজ করেছি জীবনে, আর না, বুড়ো বয়েসটা একটু শান্তিতে কাটাতে চাই। টাকার অসুবিধে নেই আমার। শান্তিতেই কাটাচ্ছিলাম এখানে, নিরিবিলি…
ড্রাগনটা এসে সব পণ্ড করল, না? জোনসের বাক্যটা শেষ করল কিশোর।
নাক কুঁচকালেন পরিচালক, হ্যাঁ। এক এক করে তাকালেন ছেলেদের মুখের দিকে, তার কথা বিশ্বাস করছে কিনা বোঝার চেষ্টা করলেন। সাগর থেকে উঠেছে। একটা কথা ডেভিসকে বলতেও বেধেছে, বলিনি, যদি হেসে ফেলে। ড্রাগনটা শুধু যে দেখেছি তাই নয়, তার গর্জনও শুনেছি।
হঠাৎ যেন বড় বেশি নীরব হয়ে গেল ঘরটা।
শুনেছেন, শান্ত রয়েছে কিশোর। শব্দটা ঠিক কেমন? তখন কোথায় ছিলেন আপনি?
ছোট তোয়ালের সমান একটা রঙিন রুমাল বের করে ঘন ভুরুর ঘাম মুছলেন জোনস। একটা টিলার ওপর। এই তো, কাছেই। ওখান থেকে পরিষ্কার দেখা যায় সাগর।…চোখের ভুলও হতে পারে, কি। জানি!
তা পারে। কিন্তু শোনাটা? শব্দ তো আর চোখের ভুল নয়?
তা নয়। তবে কানেও তো ভুল শুনতে পারি? বুড়ো হলে চোখ কান সবই খারাপ হয়ে যায়। আবার কপালে রুমাল বুলালেন তিনি। তবে, এ-ক্ষেত্রে ভুল হয়েছে এটা বিশ্বাস করতে পারছি না, দেখেছি যে সেটাও মেনে নিতে পারছি না। বাস্তবে ড্রাগন নেই, সেই রূপকথার যুগেও ছিল না, আর এখন তো থাকার প্রশ্নই ওঠে না। ড্রাগন নিয়ে ছবি বানিয়েছি আমি, সবই যান্ত্রিক দানব, খেলনা। ভারি ইঞ্জিনের গর্জনের সঙ্গে তীক্ষ্ণ হুইসেল মিলিয়ে, সেটাকে বিশেষ কায়দায় ভোতা করে চালিয়ে দিয়েছি ড্রাগনের গর্জন বলে। সেই সঙ্গে পর্দায় বিশেষ আবহ সৃষ্টির ব্যবস্থা করে ভয় পাইয়েছি হলের দর্শকদের। অন্ধকারে ভীতিকর। শোনায় ওই গর্জন।