পেছন দিকে পোর্টহোলের কাছে ছুটে গেল রবিন, কাঁচে নাক চেপে ধরে বাইরে তাকাল। কিশোর, ব্যাটারা আসছে। জলদি কিছু করো। পাগলা কুত্তা হয়ে গেছে ওরা।
গীয়ার দিয়ে ক্লাচ ছাড়তেই লাফ দিয়ে আগে বাড়ল ড্রাগন। অ্যাকসিলারেটরের ওপর প্রায় দাঁড়িয়ে গেল কিশোর, এত জোরে চাপ দিচ্ছে।
ভীষণ ঝাঁকুনি দিয়ে আবার থেমে গেল ড্রাগন, ইঞ্জিন স্তব্ধ।
দাঁতে দাঁত চেপে আবার চালু করল কিশোর। আগে বাড়ল ড্রাগন, আবার থেমে গেল।
এভাবেই চালিয়ে যাও, বলল রবিন। থেমো না।
চালু হলো ইঞ্জিন।
ওরা কদ্দূর? চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
ধরে ফেলল। চালাও।
প্রাণপণে ছুটছে দুই ডাকাত, তাদের পেছনে চেঁচামেচি করছেন। আর হাত-পা ছুঁড়ছেন মারটিন।
কয়েক ফুট এগিয়ে থেমে গেল ড্রাগন।
গতি আরও বাড়াল দুই ডাকাত।
ফ্যাকাসে হয়ে গেল রবিন। দেখছে, ড্রাগনের লেজ প্রায় ধরে ফেলেছে ওরা!…ধরল। চেপে ধরে টান দিল পেছনে। দু-জনের গায়েই মোষের জোর। ইঞ্জিন বন্ধ থাকলে টেনেই পিছিয়ে নিয়ে যাবে সাবমেরিনটাকে।
ধরে ফেলেছে! চেঁচিয়ে উঠল রবিন।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আগে বাড়ল ড্রাগন। সেই একই ব্যাপার। কয়েক ফুট গিয়েই ঝাঁকি দিয়ে থেমে গেল।
নাহ্, হবে না। কুটি করল কিশোর। কপালের ঘাম মোছারও অবকাশ নেই। এখন আর ইঞ্জিনই স্টার্ট নিচ্ছে না।
নিলেও আর লাভ নেই, হতাশ ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল রবিন। ধরে ফেলেছে।
লেজ চেপে ধরে গায়ের জোরে টানছে দুই ডাকাত, টানের চোটে পেছনে হেলে পড়েছে দু-জনের শরীর। বুঝতে পারল, টানার দরকার নেই, ইঞ্জিন স্টার্ট নিচ্ছে না। লেজ ছেড়ে দিয়ে দৌড়ে এল একজন। পা-দানী ধরে ফেলল। দেখতে দেখতে উঠে চলে এল হ্যাঁচের কাছে, টান দিয়ে খুলে ফেলল ঢাকনা।
ধরে তো ফেলল, কিশোর! কাঁদো কাঁদো হয়ে গেছে রবিন। কি করি এখন?
কি আর করার আছে? সীট থেকে উঠে সরু গলিপথ ধরে এগিয়ে এল কিশোর। আত্মসমর্পণ করব। তাহলে হয়তো আর কিছু বলবে না, কিন্তু কথাটা নিজেই বিশ্বাস করল না সে।
মই বেয়ে উঠে বাইরে হাত বের করে নাড়ল কিশোর। মিস্টার মারটিন, আমরা বেরিয়ে আসছি।
মারটিনের রাগান্বিত চিৎকার শোনা গেল। কি বললেন, কিছু বোঝা গেল না।
এই সময় বদ্ধ গুহা ভরে গেল আরেকটা বিকট চিৎকারে। ভয়ঙ্কর আওয়াজ। অন্ধকার সুড়ঙ্গের পুরু দেয়ালে প্রতিধ্বনি উঠল।
হ্যাচের বাইরে মাথা বের করেছে কিশোর। শব্দ শুনে ঝটকা দিয়ে ফিরে তাকাল। তাদের সামনের দেয়ালটা রুদ্ধ, যেটা ফাঁক ছিল খানিক আগে, যেখান দিয়ে ঢুকেছে ওরা।
খবরদার, জো! চেঁচিয়ে সাবধান করল নিক।
ওদের চেহারায় প্রথমে বিস্ময়, তারপর আতঙ্ক ফুটতে দেখল কিশোর। ওদের দৃষ্টি অনুসরণ করে তাকাল। গুহার দেয়ালে উদয় হয়েছে বিশাল এক পিঁপড়ে, যেন একটা পাহাড়। দূরে রয়েছে এখনও। ছুটে আসছে দ্রুত। বিকট চিৎকার করছে ওটাই, সুড়ঙ্গ জুড়ে যেন এগিয়ে আসছে।
রাক্ষস! খেয়ে ফেলবে! আতঙ্কে কোলা ব্যাঙের ডাক ছাড়ল নিক। টান দিয়ে পকেট থেকে পিস্তল বের করল। পিঁপড়েটাকে সই করে গুলি করল দু-বার।
গুলি খেয়েই যেন আরও বিকট চিৎকার করে উঠল পিঁপড়ে। আরও জোরে ছুটে এল। ওটার পেছনে দেখা যাচ্ছে এখন আরেকটা পিঁপড়ে।
দেখলে কাণ্ড! বিস্ময়ে কোটর থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসবে যেন নিকের চোখ। গুলি খেয়েও কিছু হলো না। টেরই পায়নি যেন! একের পর এক গুলি করে গেল সে।
গর্জন থামছে না পিঁপড়ের, অগ্রগতি কমছে না সামান্যতম। আগের দুটোর সঙ্গে আরও পিঁপড়ে এসে যোগ হয়েছে। সারি দিয়ে এগিয়ে আসছে যেন মানুষ ছিঁড়ে খাওয়ার জন্যে।
রবিন দেখল, রোভার মারটিনের চোখে বিস্ময় ফুটেছে, তবে তাতে আতঙ্ক নেই, আছে কৌতূহল।
জো-ও গুলি শুরু করেছে।
আসছে রে, আসছে! চেঁচিয়েই চলেছে নিক। খেয়ে ফেলল রে, বাবা! মেরে ফেলল!
জো-র মাথা নিকের চেয়ে ঠাণ্ডা। গুলি করে ফল হবে না বুঝতে পেরে ছুটে গেল মারটিনের কাছে। পিস্তল উঁচিয়ে ধরে চেঁচিয়ে বলল, জলদি দরজা খোলো! কুইক!।
ঠাণ্ডা চোখে ওর দিকে তাকালেন মারটিন। কাঁধ ঝাঁকালেন হতাশ ভঙ্গিতে। পকেটে হাত দিলেন। বের করলেন হুইসেলের মত একটা জিনিস। ঠোঁটে লাগিয়ে ফুঁ দিলেন।
রবিন আশা করেছিল, তীক্ষ্ণ শব্দ হবে।
কিছুই হলো না, কোন শব্দই নেই। অবাক হয়ে দেখল, ধীরে ধীরে সরে যাচ্ছে ধূসর দেয়ালের দরজা।
ফাঁক বড় হওয়ার আগেই নিকের হাত ধরে টান দিল জো, এসো।
পিঁপড়েগুলোর দিকে ফিরেও তাকাল না আর ওরা, ছুটে বেরিয়ে গেল ফাঁক দিয়ে।
পালাও, গাধার দল, পালিয়ে যাও! পেছন থেকে মুখ বাঁকিয়ে ভেঙচালেন মারটিন, নইলে যে খেয়ে ফেলবে! গবেট কোথাকার! হ্যাঁচ দিয়ে মুখ বের করে রেখেছে কিশোর, তার দিকে তাকালেন ইঞ্জিনিয়ার। খুব দেখিয়েছ যা হোক। কিন্তু এতখানি এসে খালি হাতে ফিরব না আমি। বেরোও, বেরিয়ে এসো। আবার পকেটে হাত দিলেন। বের করলেন চকচকে কালো আরেকটা মারাত্মক জিনিস। কিশোরের দিকে নিশানা করে নাড়লেন, নেমে এসো।
আগ্নেয়াস্ত্রের বিরুদ্ধে কিছু করার নেই। লক্ষ্মী ছেলের মত নেমে এল কিশোর আর রবিন।
অন্ধকার কোণের দিকে ফিরে ডাকলেন মারটিন। আর এই যে, তুমি, প্রোজেকটরওয়ালা, তুমিও এসো।
থেমে গেল পিঁপড়ের চিৎকার। দেয়াল থেকে গায়েব হয়ে গেল ওগুলো।
গু-গুলি করবেন না, অন্ধকার থেকে শোনা গেল মুসার কণ্ঠ। আমি আসছি।