কুটি করল কিশোর, নাক দিয়ে বিচিত্র শব্দ করল।
কি হয়েছে? জানতে চাইল রবিন।
ঠিক বুঝতে পারছি না। বাইরের দিকে, মানে সৈকতের দিকে মুখ করে পড়ে আছে এটা। ধূসর দেয়ালটা খোলা, কিন্তু বাইরের পথ এখনও বন্ধ। কি মানে হয়?
ঠোঁট ওল্টাল রবিন। মাথা নাড়ল, একই সঙ্গে হাতও নাড়ল। সে-ও বুঝতে পারছে না।
মনে হয়, জবাবটা কিশোরই দিল, এটার ভেতরে যে বা যারা ছিল তারা বেরিয়ে চলে গেছে। ড্রাগনটাকে এমনভাবে ফেলে রেখে গেছে, যাতে কেউ ঢুকলেই দেখে ভয়ে পালায়।
চুপ করে রইল রবিন।
ড্রাগনের মুখে টর্চের আলো ফেলল কিশোর। চোখ নয়, খুদে হেডলাইট, মুভেবল।
আবার ড্রাগনের পাশে চলে এল দু-জনে। আঁশ আঁশ কালচে চামড়ায় কি একটা চোখে পড়ল কিশোরের, হাত বাড়িয়ে চেপে ধরল। দরজার হাতল। কিন্তু দরজাটা কই?
কিশোরের কাঁধের ওপর দিয়ে তাকাল রবিন। ওই যে আরেকটা হাতল, তার ওপরে আরেকটা।
ফিক করে হাসল কিশোর। আবার বোকা বানাল। দরজার হাতল নয় ওগুলো। পা-দানী। পা রেখে উঠে যাওয়ার জন্যে।
হাতলের সিঁড়ি বেয়ে উঠে যেতে শুরু করল সে। কিছুটা উঠে ফিরে তাকিয়ে রবিনকে ওঠার জন্যে ডাকল। পিঠের ওপরে উঠে রাস্তার ম্যানহোলের মত ঢাকনাটা দেখতে পেল।
আরি, একেবারে সাবমেরিনের হ্যাঁচ, অবাক কণ্ঠে বলল কিশোর। রবিন, থাকো এখানে, পাহারা দাও। আমি নিচে যাচ্ছি।
ঢোক গিলল রবিন, কিছু বলল না, মাথা কাত করল শুধু।
উবু হয়ে হ্যাঁচের হাতল ধরে জোরে টান দিল কিশোর। উঠে গেল ঢাকনা। সিঁড়ি বেয়ে ভেতরে নামল কিশোর।
অপেক্ষা করে আছে রবিন। খানিক পরেই সাড়া এল ভেতর থেকে। থাবা দেয়া হচ্ছে খোলসে। তারমানে ড্রাগনের পেটে ঢুকে গেছে গোয়েন্দাপ্রধান।
ভয় পাচ্ছে রবিন, অস্বস্তিতে বার বার তাকাচ্ছে এদিক-ওদিক। অন্ধকারে লম্বা সুড়ঙ্গে বেশিদূর এগোচ্ছে না টর্চের আলো। সুড়ঙ্গের দেয়াল কংক্রিটে তৈরি, ছাতে ইস্পাতের কড়িবরগা।
এতই অন্যমনস্ক ছিল রবিন, হ্যাঁচ খোলার শব্দে চমকে উঠল। চেয়ে দেখল, মাথা বের করেছে কিশোর। ডাকল, এসো, দেখে যাও।
সিঁড়ি বেয়ে ভেতরে নামল রবিন।
টর্চ জ্বেলে আলো ফেলল। চমৎকার, তাই না? বাইরে থেকে মনে হয় জ্যান্ত ড্রাগন। চলে রেলের ওপর দিয়ে। এই যে দেখো, পেরিস্কোপ। আর এটা, পোর্টহোল। আসলে, রবিন, এটা একটা সাবমেরিন। অদ্ভুত সাবমেরিন।
ভেতরের দিকে বাঁকা, মসৃণ দেয়ালে হাত বোলাল রবিন। কি দিয়ে বানিয়েছে?
সাধারণত লোহা আর ইস্পাত দিয়েই সাবমেরিন বানানো হয়। তবে এটা অন্য কিছু দিয়ে তৈরি। দেখি তো, ইঞ্জিনরুমটা কেমন?
সরু গলিপথ ধরে মাথার দিকে এগোেল দু-জনে।
এক জায়গায় এসে চেঁচিয়ে উঠল রবিন, গীয়ারশিফট, ড্যাশবোর্ড, ব্রেক, প্যাডাল! কি ধরনের সাবমেরিন এটা? এক্কেবারে তো গাড়ি।
আঙুল মটকাল কিশোর। সবচেয়ে প্রথম যে সাবমেরিনটা তৈরি হয়েছিল, তার কথা বইয়ে পড়েছি। সাগরের তলার মাটি দিয়ে গাড়ির মত চাকায় গড়িয়ে চলত ওটা। গাড়ির মতই জানালা ছিল, কাঁচে ঢাকা, যাতে তার ভেতর দিয়ে বাইরে দেখতে পারে দর্শকরা। ভেতরে বিশেষ এয়ার কম্পার্টমেন্টের ব্যবস্থা ছিল, বাইরের পানির চাপ থেকে সাবমেরিনকে রক্ষা করার জন্যে। মনে হয় ওই আইডিয়াটাই কাজে লাগিয়েছে এই ড্রাগনের ইঞ্জিনিয়াররা। অনেকটা ওই রোজ বাউল ফ্লোটসের মত ব্যাপার। গাড়ির চ্যাসিসকে ফুল দিয়ে ঢেকে সাজানো হয়, জানো হয়তো। ভেতরে বসে থাকে ড্রাইভার, লুকিয়ে, তাকে। দেখতে পায় না কেউ। লো গীয়ারে গাড়ি চালায়।
এই ড্রাগনটাকেও অনেকটা ওভাবেই চালানো হয়, উত্তেজিত হয়ে উঠেছে রবিন। দেখে মনে হয় বালির ওপর দিয়ে ভেসে আসে, চাকা চোখে পড়ে না বলে। মিস্টার ক্রিস্টোফারের ওখানে যে সিনেমাটা দেখেছি, তাতে ড্রাগন কিন্তু অন্য রকমভাবে হাঁটে। দুলে দুলে, পায়ের পর পা ফেলে।
ওই ড্রাগন অন্য রকমভাবে বানানো হয়, যাতে পর্দায় আসল ড্রাগনের মত লাগে। কিন্তু এটা বানানো হয়েছে মানুষকে ভয় দেখিয়ে দূরে সরানোর জন্যে।
কেন? প্রশ্নটা করতে গিয়েও থেমে গেল রবিন। বিচিত্র একটা। গোঙানি শোনা গেল, টানা টানা।
চমকে গেল দু-জনেই।
কি-ক্কী? কণ্ঠস্বর খাদে নেমে গেল রবিনের।
ওখান থেকে আসছে, লেজের দিকে দেখাল কিশোর।
চলো, পালাই। জেগে উঠছে সাবমেরিন। পানিতে গিয়ে ডুব দিলে মরেছি। অটোপাইলটে চলে মনে হয়।
আবার শোনা গেল গোঙানি, কেমন যেন বিষণ্ণ, গা-শিরশির করা শব্দ।
কেঁপে উঠল রবিন। আমার একদম ভাল্লাগছে না!
কিন্তু তাকে বিস্মিত করে দিয়ে সরু গলিপথ ধরে ড্রাগনের লেজের দিকে ছুটে গেল কিশোর।
আবার গোঙানি শোনা গেল।
মেঝের দিকে ঝুঁকল কিশোর। কিছু বোঝার চেষ্টা করছে।
কাছে চলে এল রবিন। কী?
জবাব দিল না কিশোর। টর্চের আলো ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেয়াল পরীক্ষা করতে লাগল। তারপর রবিনকে আরেকবার অবাক করে দিয়ে হাসল। আরও একটা রহস্যের কিনারা হলো।
কিনারা?
শুনছ না? রবিনের কথার জবাব দিল না কিশোর।
কান পেতেই আছে রবিন। শুনছি তো। কিন্তু মোটেই ভাল্লাগছে না আমার।
ভয় পেয়েছ বলে লাগছে না। এসো, দেখো, ভয় কাটবে, হাসতে হাসতেই হাতল টেনে ছোট একটা দরজা খুলে ফেলল কিশোর। আলো ফেলল ভেতরে। জোরাল হলো গোঙানি।
কুকুরের গলা মনে হচ্ছে না? বকের মত গলা বাড়িয়ে দরজার ওপাশে তাকাল রবিন। আরে, কুকুরই তো! এক আলমারি ভরতি!