এত উত্তেজিত হয়েছে কিশোর, তোতলাতে শুরু করল, আ আপনার ব-বন্ধুর ঠিকানা বলুন, স্যার। দারুণ জমবে মনে হয় কেসটা, তিন গোয়েন্দার সবচেয়ে রোমাঞ্চকর কেস।
কাগজ-কলম নিয়ে তৈরিই আছে রবিন, তিন গোয়েন্দার সমস্ত কেসের রেকর্ড রাখা আর প্রয়োজনীয় লেখাপড়ার দায়িত্ব তার ওপর। লিখে নিল ঠিকানা।
ড্রাগন
ছেলেদের গুড লাক জানিয়ে লাইন কেটে দিলেন পরিচালক। দুই সহকারীর দিকে তাকাল কিশোর। এই আধুনিক যুগে জ্যান্ত ড্রাগন দেখাটা সৌভাগ্য বলতে হবে, তাই না?
মাথা ঝাঁকাল রবিন।
কিন্তু মুসা মুখটাকে এমন করে ফেলল যেন নিমের তেতো গিলেছে।
কি ব্যাপার, সেকেণ্ড, খুশি হওনি মনে হচ্ছে? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
রোমাঞ্চকর শব্দটার সঙ্গে আরও তিনটে শব্দ যোগ করা উচিত ছিল, মুখ গোমড়া করে বলল মুসা, মিস্টার ক্রিস্টোফারকে বলনি সে কথা।
ভুরু নাচাল শুধু কিশোর; অর্থাৎ, কী?
রোমাঞ্চকর এবং শেষ কেস, বলল মুসা। জ্যান্ত ড্রাগনের সামনে গেলে বেঁচে আর ফিরব না কোনদিন!
দুই
রকি বীচ থেকে প্যাসিফিক কোস্ট হাইওয়ে ধরে মাইল বিশেক গেলেই সী-সাইড, প্রশান্ত মহাসাগরের কূলের ছোট্ট একটা শহর। ঠিক হলো, লাঞ্চের পর ওখানে যাবে তিন গোয়েন্দা। নিয়ে যাবে বোরিস, ইয়ার্ডের কর্মচারী, বিশালদেহী দুই ব্যাভারিয়ান ভাইয়ের একজন। ইয়ার্ডের ছোট পুরানো ট্রাকটাতে করে কিছু মাল ডেলিভারি দিতে সে যাবে সী-সাইডের ওদিকে, তিন গোয়েন্দাকে সঙ্গে নিতে কোন অসুবিধে নেই।
মেরিচাচীর রান্না ভরপেট খেয়ে ট্রাকে এসে উঠল তিন কিশোর, বোরিসের পাশে গাদাগাদি করে বসল। ইয়ার্ড থেকে বেরিয়ে এল ট্রাক, উপকূলের ধারের মহাসড়ক ধরে ছুটে চলল দক্ষিণে।
রবিন, রেফারেন্স বই দেখেছিলে? এতক্ষণে জিজ্ঞেস করার সুযোগ পেল কিশোর, ড্রাগনের কথা কি কি জেনেছ?
ড্রাগন হলো পৌরাণিক দানব। ডানাওয়ালা বিশাল সরীসৃপ, উড়তে পারে; বড় বড় বাঁকা নখ আছে, নিঃশ্বাসের সঙ্গে আগুন বেরোয়।
আমি রেফারেন্স বই দেখিনি, মুসা বলে উঠল। কিন্তু বাজি রেখে বলতে পারি, মোটেই শান্ত স্বভাবের নয় ড্রাগন। সাংঘাতিক পাজী জানোয়ার।
তা ঠিক, সায় দিল রবিন। পৌরাণিক জীব, তারমানে বাস্তবে নেই। আর নেই যখন পাজী হলেই কি, ভাল হলেই বা কি?
ঠিক, কিশোর বলল। রূপকথার গল্পে আছে ড্রাগনের কথা। যখনকার গল্প তখন যদি সত্যি সত্যি এই জীব থেকেও থাকে, তাহলেও এতদিন পর এখনকার পৃথিবীতে থাকার কথা নয়, ইভালুশনের থিওরি তাই বলে। বিশালদেহী ডাইনোসররা যেমন আর বেঁচে নেই আজ।
না থাকলেই ভাল, মুসা বলল। কিন্তু ইভালুশনের থিওরি যদি সব প্রাগৈতিহাসিক দৈত্য-দানবকে হাওয়া করে দিয়েই থাকে, এই ড্রাগনটা এল কোত্থেকে?
মুসার কথায় কান না দিয়ে কিশোর বলল, গত হপ্তায় সী-সাইড থেকে পাঁচটা কুকুর হারিয়েছে, তার মধ্যে মিস্টার ক্রিস্টোফারের বন্ধুরটাও থাকতে পারে। বাড়ির কাছে ড্রাগনও দেখেছেন তিনি। কিছু বোঝা যায়?
নিশ্চয় যায়, বলল মুসা, ওসব কুকুরকে ধরে ধরে খেয়ে ফেলে। ড্রাগনটা। মানুষের মাংসেও নিশ্চয় তার অরুচি হবে না। ড্রাগন ধরতে যাওয়াটা মোটেও উচিত হবে না আমাদের।
ধরতে পারলে তো কাজই হত। রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যেতাম। আমরা।
বিখ্যাত হয়ে লাভটা কি হবে?
সে সব তুমি বুঝবে না।
সী-সাইডে ঢুকল ট্রাক। ঠিকানা বলল কিশোর।
গতি কমিয়ে রাস্তাটা খুঁজতে শুরু করল বোরিস। আরও মাইলখানেক এগিয়ে গাড়ি থামাল। মনে হয় এটাই।
পাতাবাহারের উঁচু বেড়া, তারপরে সারি সারি পাম গাছ, বাড়িটা থাকলে লুকিয়ে আছে তার ওপারে।
গাড়ি থেকে নামল ছেলেরা।
বোরিস, কিশোর বলল, দুই ঘণ্টার বেশি লাগবে না। ফেরার পথে নিয়ে যাবেন।
বলল ও-কে, কিন্তু উচ্চারণের কারণে শব্দটা শোনাল হো-কে। কর্কশ ভারি কণ্ঠস্বর তার। ট্রাকের মুখ ঘুরিয়ে সরু পথটা ধরে চলে গেল। আবার শহরের দিকে।
চলো, আগে আশপাশটায় একবার চোখ বুলিয়ে নিই, পরামর্শ দিল কিশোর। সুবিধে হবে।
পাহাড়ী এলাকা, উঁচু ঢালের ওপর বাড়ি। পুরো অঞ্চলটাই কেমন নিঃসঙ্গ, নির্জন। চিত্রপরিচালকের বাড়ির সামান্য দূরে ছোট একটা খোলা জায়গায় এসে দাঁড়াল ছেলেরা, নিচে তাকাল। পাহাড়টা এখানে। খাড়া নেমে গেছে অনেক নিচের সৈকতে। তীরে এসে ঢেউ ভাঙছে।
সেদিক তাকিয়ে রবিন বলল, খুব সুন্দর। কি শান্তি।
বলল, খুব সুন্দরে এসে ঢেউটা এখানে
শান্তি না ছাই, গজগজ করল মুসা, ঢেউ দেখেছ একেকটা!
তেমন আর বড় কই? কিশোর বলল। ফুট তিনেকের বেশি না। তবে রাতে জোয়ারের সময় নিশ্চয় আরও ফুলে ওঠে। ড্রাগন আসার উপযুক্ত সময় তখন। ঢেউয়ের তলায় লুকিয়ে লুকিয়ে চলে আসতে পারবে। বকের মত গলা বাড়িয়ে নিচে তাকাল সে। গুহাটা দেখা যায় না। এখান থেকে দেখা যাবে না। আগে কথা বলে আসি মিস্টার জোনসের সঙ্গে, তারপর নেমে দেখব।
সৈকতের দিক থেকে চোখ ফেরাল না রবিন। নামবে কি করে?
পুরানো কয়েকটা তক্তা দেখাল মুসা, ধাপে ধাপে নেমে গেছে। এককালে বোধহয় সাদা ছিল ওগুলো, কিন্তু এখন আর রঙ চেনা যায় না। রোদ, বৃষ্টি এবং সাগরের নোনা হাওয়ায় করেছে এই অবস্থা। সিঁড়ির কি ছিরি, বলল সে, নামতে গেলেই খসে পড়ে কোমর ভাঙবে।
খাড়া পাড়ের কিনারটা দেখিয়ে কিশোর বলল, আরও সিঁড়ি নিশ্চয় আছে। এখান থেকে দেখছি না বটে, খুঁজলেই পাওয়া যাবে। চলো এবার, বাড়িটাতে ঢুকি।