এসো, নিচু কণ্ঠে ডাকল কিশোর। যাই। মিস্টার হেরিঙ অনেক দূরে চলে গেছেন। এ-ই সুযোগ, সিঁড়ি দিয়ে নেমে পড়া দরকার। মাথা নামিয়ে রাখো।
সিঁড়ির কাছে প্রায় ছুটে চলে এল ওরা।
ভালমত দেখে বলল মুসা, কেউ নেই।
নিঃশব্দে সিঁড়ি বেয়ে নামল তিনজনে। হাঁপ ছাড়ল। ঢেউয়ের গর্জন এখন তাদের পায়ের শব্দ ঢেকে দেবে, কারও কানে পৌঁছবে না।
চলো, জলদি চলল, তাড়া দিল মুসা। গুহায় ঢুকি। দেখি গিয়ে সিনেমা কেমন পছন্দ ড্রাগনের।
যদি সে বাড়িতে থেকে থাকে, কিশোর যোগ করল।
না থাকলেই আমি খুশি, রবিন বলল। আমার আকর্ষণ ওই সুড়ঙ্গ।
গুহার কাছে এসে গতি কমাল দুই সহকারী গোয়েন্দা। কিন্তু তাদেরকে অবাক করে দিয়ে এগিয়েই চলল কিশোর।
এই, কিশোর, এটাই তো, রবিন বলল।
নীরবে ঘাড় নেড়ে সায় দিল কিশোর। ইঙ্গিতে দেখাল ঠেলে বেরিয়ে থাকা চূড়াটা। ওপাশে রয়েছে বড় গুহাটার মুখ। চলো, দেখি, খুঁজে বের করতে পারি কিনা।
চূড়ার নিচে এসে থামল ওরা। মাথার ওপরে তিনটে বিশাল পাথরের চাঙড় চূড়ার গায়ে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে রয়েছে।
বোধহয় ওগুলো নকল, আনমনে বলল কিশোর। মুসা, নাগাল পাবে তুমি। চাপড় দিয়ে দেখো তো। মনে হয় এর নিচেই দরজা, লুকিয়ে রাখা হয়েছে।
এগিয়ে গিয়ে একটা পাথরে চাপড় দিল মুসা। ভোতা, ফাপা শব্দ। মুচকে হেসে বলল, ঠিকই বলেছ। পাথর নয়, নকল। সিনেমার স্টুডিওতে যেমন তৈরি করে, হালকা কাঠ, প্লাস্টার আর তার দিয়ে।
মাথা নেড়ে সায় জানিয়ে ঘুরে দাঁড়াল কিশোর। চলো, তোমাকে গুহায় রেখে আসি। তারপর আমি আর রবিন ঘুরতে বেরোব।
কী? চমকে উঠল মুসা। আমাকে একা…
আমাদের চেয়ে অনেক নিরাপদে থাকবে তুমি, ভরসা দিল কিশোর। এগোল প্রথম গুহামুখের দিকে। আমাদের কাজ অনেক বেশি বিপজ্জনক। গঁাট হয়ে বসে থাকবে চুপচাপ, সিনেমা দেখানোর জন্যে তৈরি হয়ে।
বিস্ময় গেল না মুসার। আশপাশে তাকাল। দেখাব কাকে? বাদুড় টাদুড় কোন কিছু…
জবাব না দিয়ে গুহায় ঢুকে পড়ল কিশোর। পেছনে রবিন। মুসাকেও ঢুকতে হলো।
ছোট গুহাটার সামনের তক্তা সরিয়ে ফেলল কিশোর। সাবধানে ঢুকল ভেতরে। অনুসরণ করল সহকারীরা। তক্তাটা আবার আগের জায়গায় লাগিয়ে রাখল সে।
নরম শিস দিয়ে উঠল কিশোর। এই যে, আমাদের জিনিসপত্র, যেগুলো ফেলে গিয়েছিলাম। থাক, যাওয়ার সময় নেব। রবিন, দেখো তো পাথরটা আবার খুলতে পারো কিনা।
এগিয়ে গিয়ে ঝুঁকে বসল রবিন। সামান্য চেষ্টার পরেই আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল, পেরেছি।
ঘড়ঘড় করে ঘুরে গেল পাথরের দরজা, ওপাশে ঢোকার পথ মুক্ত।
মুসা, কিশোর বলল, এখানেই থাকো। এই ফাঁক দিয়ে প্রোজেকটরের মুখ বের করে গুহার দেয়ালে ছবি ফেলবে। ফাঁকে পাথর আটকে দিচ্ছি, পুরোপুরি আর বন্ধ হবে না, দরজাটা। আমি সঙ্কেত দিলেই ছবি শুরু করবে।
পা ছড়িয়ে আরাম করে বসে প্রোজেকটর খুলতে শুরু করল মুসা। টর্চের আলোয় ফিল্মের ক্যানটা দেখল, সিধে করে নিয়ে মেশিনে ফিতে পরাতে পরাতে বলল, ঠিক আছে। সঙ্কেতটা কি?
ভেবে নিয়ে বলল কিশোর, বাঁচাও! বাঁচাও!
সতেরো
মুসাকে রেখে বিশাল গুহায় বেরিয়ে এল কিশোের আর রবিন। এগিয়ে চলল। বাতাস ভেজা ভেজা, ঠাণ্ডা, গায়ে কাঁটা দিল ওদের।
খানিকটা এগিয়ে বলে উঠল রবিন, আরি!
কি?
খোলা। আলো ফেলল সামনে। ধূসর ছড়ানো দেয়ালের মাঝে একটা ফোকর। কিংবা বলা যায় মস্ত এক ফাঁক, মেঝে থেকে ছাত পর্যন্ত।
রবিন, মনে হয় হারানো সুড়ঙ্গটা পাওয়া গেল।
খুব সাবধানে ফাঁক দিয়ে অন্যপাশে বেরিয়ে এল ওরা।
সুড়ঙ্গ এখানে আরও বেশি চওড়া, উচ্চতা বেশি। লম্বা হয়ে চলে গেছে সামনে। যতদূর দৃষ্টি চলে, কিছু নেই, তারপরে অন্ধকার।
আরও কিছুদূর এগিয়ে থমকে দাঁড়াল দু-জনে। ধড়াস করে উঠল বুকের মধ্যে। খাড়া হয়ে গেল ঘাড়ের রোম।
সুড়ঙ্গের আবছা অন্ধকারে হুমড়ি খেয়ে আছে বিরাট এক ছায়া, শান্ত, নিথর।
প্রায় ঝাঁপ দিয়ে মেঝেতে পড়ল ওরা। উপুড় হয়ে শুয়ে হাঁপাতে লাগল। জোরে নিঃশ্বাস ফেলতেও ভয় পাচ্ছে।
চুপ করে আছে তো আছেই। কিছুই ঘটল না।
ড্রাগনটা যেমনি ছিল তেমনি রয়েছে। লম্বা গলার ডগায় বসানো মাথাটা লুটিয়ে আছে মাটিতে।
ঘু-ঘুমোচ্ছে, ফিসফিস করে বলল রবিন।
মাথা নাড়ল কিশোর। কণ্ঠস্বর স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে। ভুলে যাও কেন, আসল না-ও হতে পারে।
সেটা তোমার ধারণা। হতেও পারে।
আরও কিছুক্ষণ চুপ করে রইল ওরা। তারপর টর্চ জ্বালল কিশোর। ধীরে ধীরে আলোকরশি এগিয়ে নিয়ে গেল ড্রাগনের দিকে। হঠাৎ হাসি ফুটল মুখে। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। ড্রাগনের নিচের দিকে দেখো, পায়ের জায়গায়, পুরোপুরি স্বাভাবিক হয়ে গেছে কণ্ঠস্বর।
চোখ মিটমিট করল রবিন। বিশ্বাস করতে পারছে না। লাইন! রেললাইনের মত!
উঠে বসল কিশোর। যা আন্দাজ করেছিলাম, ওটা বানানো ড্রাগন। এই লাইনই তৈরি করেছিল ডন কারটার। তবে একটা কথা ভুল। বলেছ, রবিন। বলেছ, ওটা কখনও ব্যবহার হয়নি।
ভুল কই বললাম?
ভুলই তো বলেছ। ড্রাগনটা ওই লাইন ব্যবহার করছে না?
করছে!
হ্যাঁ, করছে। এখনই বুঝতে পারবে। চলো, গিয়ে দেখি। তাড়াতাড়ি করতে হবে, ওরা চলে আসতে পারে।
কারা? জিজ্ঞেস করল রবিন।
জবাব দিল না কিশোর। হাঁটতে শুরু করেছে।
সুড়ঙ্গ জুড়ে পড়ে থাকা বিশাল আকৃতিটার কাছে এসে দাঁড়াল ওরা।