ভাগো, বলেই দৌড় দিল কিশোর।
এক ছুটে গুহা থেকে বেরিয়ে দৌড়ে চলল সৈন্ত ধরে। পাশে ছুটছে মুসা। রবিন পেছনে।
ওদের হাতের টর্চ নাচছে ছোটার তালে তালে, আলোর বিচিত্র রেখা তৈরি করছে বালিতে বার বার। ভাঙা সিঁড়িটা পেরিয়ে এল। এসে পৌঁছল ভাল সিঁড়িটার গোড়ায়। থামল না। পুরানো কাঠ ভেঙে পড়ার পরোয়া করল না, উঠে চলল একজনের পেছনে একজন। পাড়ের ওপরে নিরাপদ জায়গায় উঠে যেতে চায় যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। ওখানে রয়েছে হ্যাঁনসন আর রাজকীয় রোলস রয়েস, একবার পৌঁছতে পারলে ছুটিয়ে নিয়ে যাবে ড্রাগনের কাছ থেকে দূরে। কিন্তু পারবে তো? পেছনে শোনা যাচ্ছে দানবের ভয়াবহ গর্জন।
অর্ধেক সিঁড়ি উঠে যাওয়ার পরেও ড্রাগনটাকে দেখা গেল না, তাদেরকে কামড়াতে এল না ভয়াবহ চোয়াল। শুধু শব্দ শোনা যাচ্ছে।
ওপরে উঠে এল ওরা। হাপরের মত ওঠানামা করছে বুক।
সামনে, দূরে লস অ্যাঞ্জেলেস শহরের আলো মিটমিট করছে। পথের মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে রোলস রয়েস।
গাড়ির কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল কিশোর, হ্যানসন, বাড়ি চলুন!
নিশ্চয়। উঠুন।
প্রাণ পেল বিশাল ইঞ্জিন। শাঁ করে মোড় নিয়ে প্যাসিফিক কোস্ট হাইওয়ে ধরে তীব্র গতিতে ছুটে চলল গাড়ি।
একটু সুস্থির হয়ে নিয়ে মুসা বলল, এত জোরে দৌড়তে পারো তুমি, কিশোর, জানতাম না।
আমিও না, গাল ফুলিয়ে মুখ দিয়ে বাতাস বের করে দিল কিশোর। দৌড়েছি কি আর সাধে?…জীবনে আর কখনও ড্রাগনের সামনে পড়েছি, বলো?
চামড়ামোড়া নরম গদিতে হেলান দিল রবিন। উফ্, বড় বাঁচা বেঁচেছি আজ। আরেকটু হলেই…
…গেছিলাম, কথাটা শেষ করে দিল মুসা। কিশোর, ড্রাগনের সামনে যে পড়ব কি করে জানলে তুমি? শুরু থেকেই হুঁশিয়ার ছিলে দেখেছি।
এমনি, না জেনেই হুঁশিয়ার। ড্রাগন দেখা গেছে শুনেছি তো।
আরিব্বাপরে, কি চেহারা ওটার। জীবনে ভুলব না।
আমি এখনও বিশ্বাস করতে পারছি না, রবিন মাথা নাড়ল। যত বই পড়েছি, কোনটাতেই লেখা নেই যে ড্রাগন, আজও বেঁচে আছে। কোনদিন ছিল, সে কথাও বিশ্বাস করেন না বিজ্ঞানীরা। ছিল শুধু রূপকথাতেই।
মাথা দোলাল কিশোর। চিমটি কাটতে শুরু করল নিচের ঠোঁটে। কোনদিন ছিল কিনা জানি না, কিন্তু এখন নেই। আর বাস্তবে যদি না-ই থাকে, তাহলে ড্রাগন দেখিনি।
কি বলছ? মুসা বলল। তিনজোড়া চোখ ভুল দেখতে পারে না। গুহায় ওটা কি দেখলাম? গরম নিঃশ্বাস এখনও গায়ে লাগছে মনে হচ্ছে।
আমারও লাগছে, রবিন বলল।
এক্সকিউজ মী, জেন্টলমেন, আর চুপ থাকতে পারল না হ্যাঁনসন। ড্রাগন দেখেছেন? জ্যান্ত?
হ্যাঁ, মুসা জবাব দিল। সাগর থেকে উঠে সোজা এসে ঢুকল গুহায়, আমরা যেটাতে ছিলাম সেটাতেই। আচ্ছা, হ্যাঁনসন, আপনার কি মনে হয়, ড্রাগন আছে?
মাথা নাড়ল শোফার। আমার মনে হয় না। তবে, স্কটল্যাণ্ডে শুনেছি ড্রাগনের মত একটা জীব আছে, অনেকে নাকি দেখেছে। বিশাল এক লেকে থাকে দানবটা।
লক নেস মনস্টারের কথা বলছেন? আগ্রহ দেখাল কিশোর।
হ্যাঁ। লোকে আদর করে ডাকে নেসি। একশো ফুট লম্বা।
আপনি কখনও দেখেছেন?
না। ছেলেবেলায় অনেকবার গেছি ওই হ্রদের ধারে, শুধু নেসিকে দেখতে। কিন্তু একবারও চোখে পড়েনি।
হুম। ড্রাগন তো তাহলে নিশ্চয় দেখেননি।
দেখেছি, পথের দিকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছে, হ্যাঁনসনের হাসিটা। দেখতে পেল না ছেলেরা।
দেখেছেন! এই না বললেন, দেখেননি?
দেখেছি, ফুটবল মাঠে, খেলার আগে।
ফুটবল মাঠে? বুঝতে পারছে না রবিন।
মাথা ঝাঁকাল হ্যাঁনসন। নতুন বছরের খেলার সময় প্যাসাডেনার লোকেরা বেলুনে বেঁধে ড্রাগন ছেড়ে দেয় আকাশে।
হ্যাঁনসন দেখেছে শুনে উত্তেজনায় সামনে ঝুঁকে বসেছিল মুসা, চেপে রাখা নিঃশ্বাসটা ফোঁস করে ছেড়ে বলল, ওগুলো তো ফুল দিয়ে বানানো, তাই না, কিশোর?
হ্যাঁ। আমি জিজ্ঞেস করছি, আসল ড্রাগন দেখেছেন কিনা।
আমাদের মত, যোগ করল মুসা।
না।
আবার নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটা শুরু করল কিশোর। চুপচাপ চেয়ে আছে জানালা দিয়ে পথের দিকে।
স্যালভিজ ইয়ার্ডে পৌঁছল রোলস রয়েস। হ্যাঁনসনকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলল কিশোর, দরকার পড়লেই আবার ডাকবে।
ভেরি গুড, মাস্টার পাশা, হ্যাঁনসন বলল। আপনাদের সঙ্গে সময়টা খুব ভাল কাটে। ধনী বিধবাদের কাজ করতে বিরক্ত লাগে। তাই আপনারা যখন ডাকেন, খুশিই হই। কিছু মনে না করলে, একটা প্রশ্নের জবাব দেবেন?
নিশ্চয়। কি?
রক্ত-মাংসের জ্যান্ত ড্রাগন দেখেছেন আজ আপনারা? খুব কাছে থেকে?
কাছে মানে? বলে উঠল মুসা। হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারতাম। গায়ের ওপর এসে উঠেছিল।
আপনাদের নিশ্চয় জানা আছে, নিঃশ্বাসের সঙ্গে ড্রাগনের নাকমুখ দিয়ে আগুন বেরোয়। ওটার কি বেরিয়েছিল?
আস্তে মাথা নাড়ল কিশোর। না, আগুন দেখিনি। তবে ধোয়া-হা, ধোঁয়া বেরিয়েছে বলা যায়।
তাহলে ড্রাগনের আসল ভয়ঙ্কর রূপই দেখেননি…
যা দেখেছি তা-ই যথেষ্ট, বাধা দিয়ে বলল মুসা। অনেক দিন ঘুমাতে পারব না। ভাবলেই রোম খাড়া হয়ে যায়।
আর কিছু না বলে গাড়ি নিয়ে চলে গেল হ্যাঁনসন।
জাঙ্কইয়ার্ডে ঢুকল তিন গোয়েন্দা। চাচা-চাচীর বেডরুমে আলো নেই, ঘুমিয়ে পড়েছেন। শুধু কিশোরের ঘরে স্লান একটা আলো জ্বলছে।
বন্ধুদের দিকে ফিরল কিশোর। আমাদের বোধহয় আরেকবার গুহায় যেতে হবে।