ওপাশে আরও গুহাটুহা আছে হয়তো, অনুমান করল রবিন। হয়তো ওই পাশটা গরম।
মাথা নাড়ল কিশোর। যুক্তিটা মানতে পারছে না। পকেট থেকে ছুরি বের করল।
হেসে উঠল মুসা। পাগল! ছুরি দিয়ে পাথর কাটবে? ফলা ভাঙবে খামাকা। ডিনামাইট দরকার।
মুসার কথায় কান না দিয়ে আঁচড় কাটল কিশোর। ছুরির আগা দিয়ে খোঁচা দিল। ধূসর আঠা আঠা পদার্থ লেগে গেল ছুরির ফলায়।
সঙ্গীদের দিকে ফিরল গোয়েন্দাপ্রধান। মুখে জয়ের হাসি, যেন সাংঘাতিক কিছু আবিষ্কার করে ফেলেছে। দুই গোয়েন্দার কাঁধের ওপর দিয়ে চোখ পড়তেই হাসি মুছে গেল মুখ থেকে। আ-আরে খুলে যাচ্ছে …
চরকির মত পাক খেয়ে ঘুরল দুই সহকারী গোয়েন্দা। বিশ্বাস করতে পারছে না। এ-কি কাণ্ড? সরে যাচ্ছে দেয়াল।
খুলছে খুলছে-ফিকে হচ্ছে অন্ধকার। বাতাস এসে লাগল ওদের মুখে।
স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে আছে ওরা। দুরুদুরু করছে বুক। দেয়ালের খোলা জায়গা দিয়ে আবছামত চোখে পড়ল সৈকতের বালি, তার পেছনে সাগরের সীমারেখা।
আগে সামলে নিল কিশোর। জলদি! ছোট গুহাটায় ঢোকো…
ছুটে এসে প্রায় দেয়ালে ঝাঁপ দিয়ে পড়ল তিন গোয়েন্দা, এখান দিয়েই বেরিয়েছিল।
পাগলের মত লিভার খুঁজতে শুরু করল রবিন। পেল না। কাঁধ দিয়ে জোরে ধাক্কা দিল দেয়ালে। খুলল না। সঙ্গীদের দিকে ফিরে বলল, খুঁজে পাচ্ছি না..! গলা কাঁপছে।
পেতেই হবে, জোর দিয়ে বলল কিশোর।
তিনজনে তিন জায়গায় খুঁজতে লাগল। কোন ধরনের হাতল বা এমন কিছু রয়েছে, যাতে চাপ লাগলে খুলে যায় দরজা।
হঠাৎ আলোর বন্যায় ভেসে গেল গুহার ভেতর। জমে গেল যেন তিন কিশোর। দেয়াল আরও ফাঁক হয়েছে। কি যেন আসছে, এদিকেই। বিশাল একটা ছায়ামত, সাগর থেকে উঠেছে।
কিশোরের কাঁধ খামচে ধরল মুসা। সত্যিই দেখছি তো. কথা আটকে গেল।
কিশোরও স্তম্ভিত। মাথা নেড়ে সায় দিল। গলা শুকিয়ে কাঠ, চোখের পাতা ফেলছে ঘনঘন। ড্রাগন!
এগিয়ে আসছে দানবীয় সরীসৃপ। ভেজা চকচকে চামড়া, পানির কণা লেগে আছে। শরীরের তুলনায় ছোট মাথা, ত্রিকোণ। এদিক ওদিক দুলছে লম্বা সাপের মত গলা। হলুদ দুই চোখ থেকে আলো আসছে গুহার ভেতরে, যেন দুটো বিশাল, হেডলাইট। একটানা শব্দ করছে, অদ্ভুত একধরনের গুঞ্জন।
দেয়ালের খোলা অংশ জুড়ে দাঁড়াল ওটা। প্রাগৈতিহাসিক ডাইনোসর যেন মাথা নোয়াল। হাঁয়ের ফাঁকে লকলকে জিভটা ঢুকছে বেরোচ্ছে। ভোস ভেঁাস করে শ্বাস ফেলছে, যেন দীর্ঘশ্বাস।
হাতল খোঁজায় বিরতি দিল না ওরা। বার বার দেয়ালে ধাক্কা দিয়ে দেখছে, খোলে কিনা।
গুহায় ঢুকছে ড্রাগন। শ্বাস টানছে জোরে জোরে, হাঁপানী রোগীর মত।
দেয়ালের গা ঘেঁষে দাঁড়াল ওরা, কুঁকড়ে বাঁকা করে রেখেছে। শরীর। আত্মরক্ষার ভঙ্গিতে হাত উঠে গেছে মাথার ওপর।
লম্বা গলাটা বাড়িয়ে দিল ড্রাগন।
ভেজা চোয়াল ঝুলে পড়ল নিচে, বেরোল একসারি ঝকঝকে সাদা ধারাল দাঁত। আবার জোরে জোরে শ্বাস টানল কয়েকবার, ছোট্ট একটা কাশি দিয়ে থেমে দাঁড়াল।
আমাজনের জঙ্গলের জাগুয়ারের কথা মনে পড়ল কিশোরের। শিকার ধরার আগে এরকম করেই কাশে ওই ভয়ানক বাঘ। তারমানে ড্রাগনও এখন শিকার ধরবে।
কালচে মাথাটার দিকে স্থির হয়ে আছে কিশোরের চোখ, নড়াতে পারছে না, যেন সম্মোহিত করে ফেলেছে তাকে দানটা। ঝটকা দিয়ে মাথা সামনে বাড়াল, কিশোরকে ধরার জন্যেই বোধহয়।
পিছু হটার জায়গা নেই, বন্ধুদের কাছে সরে এল কিশোর। আঙুলগুলো মরিয়া হয়ে খুঁজল পেছনের দেয়াল। ইস্, কোথায় হাতলটা?
এগিয়ে আসছে ড্রাগনের হাঁ করা চোয়াল। গায়ে এসে লাগছে বাষ্পের মত ভেজা উত্তপ্ত নিঃশ্বাস।
বারো
পেছনের দেয়ালে কিট করে একটা শব্দ হলো। ঘড়ঘড় করে সরে গেল পাথর। ফোকর দিয়ে ভেতরে উল্টে পড়ল রবিন। তাকে ঠেলে সরিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকল মুসা। তার পর-পরই ঝাঁপ দিয়ে পড়ল কিশোর।
বন্ধ হয়ে গেল আবার পাথরের দরজা।
হাঁপ ছাড়ল ছেলেরা। কিন্তু সেটা ক্ষণিকের জন্যে।
ড্রাগনের চাপা, গর্জন শোনা যাচ্ছে ওপাশ থেকে। কেঁপে উঠল দেয়াল। থাবা মারছে যেন দানবটা, ধাক্কা দিচ্ছে।
ভাঙতে চাইছে। চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
গর্জন বাড়ছে ওপাশে। ধাক্কায় থরথর করে কাঁপছে গুহার দেয়াল। ছাত থেকে ঝরতে শুরু করল বালি আর ছোট ছোট পাথর।
বাতাসে বালি উড়ছে, নাক দিয়ে ঢুকছে বালির কণা। দাঁতে কিচকিচ করছে বালি। কেশে উঠল মুসা, থুথু করে থুতু ফেলল।
ভূমিধস!
পড়েছি ফাঁদে আটকা! রবিনও কাশতে শুরু করল। দম বন্ধ হয়ে মরব এবার!
মনে পড়ল কিশোরের, বলা হয়েছে এখানে যখন তখন ভূমিধস নামে, জ্যান্ত কবর হয়ে যায় লোকের। কত লোক যে মরেছে এভাবে তার হিসেব নেই। বোঝা যাচ্ছে বানিয়ে বলেননি মিস্টার জোনস।
আরও পাথর পড়ল। ওপাশে যেন পাগল হয়ে গেছে ড্রাগনটা। গর্জনে কান ঝালাপালা।
ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল কিশোর, আতঙ্কে বুদ্ধি ঘোলা হয়ে গেছে। নইলে এই গুহা থেকেও যে বেরিয়ে যাওয়া উচিত সে কথা মনে পড়ত। তক্তার ওপর চোখ পড়তেই চেঁচিয়ে উঠল, তক্তা! বেরিয়ে যেতে হবে!
লাফ দিয়ে এগিয়ে গেল তিনজনে। পাগলের মত মাটি সরাতে লাগল দুই হাতে। যখন মনে হলো, আর কোনদিনই সরাতে পারবে না, ঠিক এই সময় নড়ে উঠল তক্তাটা।
ছোট ফাঁক দিয়ে হুড়োহুড়ি করে বেরিয়ে এল ওরা। তক্তাটা আবার জায়গামত বসিয়ে লাথি দিয়ে দিয়ে বালি ঠাসতে লাগল ওটার গোড়ায়। হাঁপাচ্ছে জোরে জোরে।