জটিল রহস্য? রবিনের দিকে একবার তাকিয়ে আবার কিশোরের দিকে ফিরল মুসা, কুকুর হারানোটা একটা অতি সাধারণ ঘটনা, দু চারটা সব সময়ই হারায়। এর মধ্যে রহস্য দেখলে কোথায়?
কর্তৃপক্ষ যখন সমাধান করতে পারছে না, নিশ্চয় রহস্য। আচ্ছা, নাক গলানো বলছি কেন? নিজেকেই যেন বোঝাল কিশোর। আমরা গোয়েন্দা, যে কোন রহস্যের সমাধান করার জন্যে এগিয়ে যেতে পারি। সী-সাইড এখান থেকে বেশি দূরে না, ইচ্ছে করলেই চলে যেতে পারি। যাচ্ছি না কেন?
কার্ড ছাপানো শেষ, মেশিন বন্ধ করে দিল রবিন। ঘটারং-ঘট, ঘট ঘটু-ঘটাং করে অন্তিম আর্তনাদ তুলে চুপ হয়ে গেল আদিম যন্ত্রটা। একটা কার্ড হাতে নিয়ে ছাপাটা দেখে নিজেই নিজের প্রশংসা করল সে, চমৎকার ছেপেছি।
হুঁ, ভালই, দেখে বলল কিশোর। চলো, হেডকোয়ার্টারে গিয়ে আলোচনা করি। জবাবের অপেক্ষা না করেই উঠে পড়ল সে।
পরস্পরের দিকে তাকাল অন্য দু-জন। তারপর গোয়েন্দাপ্রধানকে। অনুসরণ করল। বলে কোন লাভ হবে না যে জানে, তবু হেসে বলল মুসা, গণতান্ত্রিক দেশে বাস করছি আমরা, কিশোর, আমাদের তিনজনের মধ্যেও গণতান্ত্রিক চেতনা থাকা উচিত। যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে ভোটাভুটি আবার চালু করলে কেমন হয়?
কিন্তু কিশোর শুনল বলে মনে হলো না। ছাপার মেশিনটার খানিক দূরে মোটা একটা পাইপের মুখ থেকে একটা লোহার পাত সরাচ্ছে। হামাগুড়ি দিয়ে পাইপের ভেতর ঢুকে গেল সে। কি আর করবে, মুসাও ঢুকল তার পেছনে। সব শেষে ঢুকল রবিন, ভেতরে থেকেই হাত বাড়িয়ে পাতটা আবার দাঁড় করিয়ে দিল পাইপের মুখে, ঢেকে দিল। কৃত্রিম সুড়ঙ্গমুখ। হেডকোয়ার্টারে ঢোকার এটা একটা গোপন পথ, ওরা নাম রেখেছে দুই সুড়ঙ্গ। ১৪ পাইপের মেঝেতে নরম কার্পেট বিছানো রয়েছে, কাজেই হামাগুড়ি দিয়ে এগোতে কোন কষ্ট হচ্ছে না। প্রায় চল্লিশ ফুট মত জঞ্জালের ভেতর দিয়ে এগিয়ে একটা ট্রেলারের তলায় এসে শেষ হয়েছে পাইপ। মাথায় আলগা ঢাকনা, ওপর দিকে খোলে। ঠেলে তুলে ট্রেলারের ভেতরে ঢুকল কিশোর।
এক সময় এটা একটা মোবাইল হোম ছিল, দুর্ঘটনায় পড়ে না কিভাবে যেন ভেঙে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, বাতিল অবস্থায় কিনে এনেছিলেন রাশেদ পাশা। কোনভাবেই আর বিক্রি করতে না পেরে দিয়ে দিয়েছেন ছেলেদের। জঞ্জালের তলায় এখন পুরোপুরি চাপা পড়েছে ট্রেলারটা, বাইরে থেকে দেখা যায় না।
ওটাকেই সারিয়ে নিয়ে ভেতরে হেডকোয়ার্টার করেছে তিন। গোয়েন্দা। সাজানো-গোছানো ছোট্ট অফিস, খুদে ল্যাবরেটরি, ছবি প্রসেস করার ডার্ক-রুম, টেলিফোন, টাইপরাইটার, আর নানারকম আধুনিক প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আছে তাতে।
ডেস্কের ওপাশে নিজের চেয়ারে গিয়ে বসল কিশোর। পুরানো নষ্ট রিভলভিং চেয়ারটা অল্প পয়সায় কিনে এনে সারিয়ে নিয়েছে সে নিজেই। ডেস্কটাও পুরানো। কিন্তু ঘষেমেজে বার্নিশ করে চকচকে করে তোলা হয়েছে, নতুনই মনে হয় এখন। রবিন আর মুসা বসল তাদের চেয়ারে।
ঠিক এই সময় বাজল টেলিফোন।।
তিনজনেই তাকাল একে অন্যের দিকে। কোন রহস্যের তদন্তের সময় না হলে সাধারণত ফোন করে না কেউ তাদেরকে।
দ্বিতীয়বার রিঙ হতেই রিসিভার তুলে নিল কিশোর। কানে ঠেকানোর আগে একটা সুইচ টিপল। স্পীকারের সঙ্গে যোগাযোগ অন হয়ে গেল, সবাই একসঙ্গে শুনতে পাবে এখন ওপাশের কথা।
কিশোর পাশা? মহিলা কণ্ঠ, মিস্টার ক্রিস্টোফার কথা বলবেন।
নতুন কেস! প্রায় চেঁচিয়ে উঠল রবিন। হলিউডের বিখ্যাত। চিত্রপরিচালক ডেভিস ক্রিস্টোফার ফোন করলে বুঝতে হবে, নতুন একটা জটিল কেস পাওয়ার সম্ভাবনা খুব বেশি।
হাল্লো, কিশোর পাশা, স্পীকারে গমগম করে উঠল পরিচালকের কণ্ঠ। হাতে কোন কাজ আছে তোমাদের? আই মীন, কোন কেস?
না, স্যার। তবে মনে হচ্ছে একটা কিছু পাব এবার?
কি করে বুঝলে?
আপনি ফোন করেছেন।
মৃদু হাসি শোনা গেল। ঠিকই আন্দাজ করেছ। আমার এক পুরানো বন্ধু, এক্স ফিল্ম ডিরেক্টর একটা সমস্যায় পড়েছে।
কি সমস্যা, স্যার? সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন করল কিশোর।
দ্বিধা করছেন পরিচালক। অল্প কথায় কিভাবে পরিবেশন করবেন কথাটা, ভাবছেন বোধহয়, সাজিয়ে নিচ্ছেন মনে মনে। অবশেষে বললেন, কুকুর। এই খানিক আগে ফোন করে বলল, তার কুকুরটা খুঁজে পাচ্ছে না।
উজ্জ্বল হলো কিশোরের চোখ। আপনার বন্ধু কি সী-সাইডে থাকেন?
দীর্ঘ এক মুহূর্ত নীরবতার পর যখন কথা বললেন পরিচালক, বোঝা গেল তাজ্জব করে দিয়েছে তাঁকে কিশোর। হ্যাঁ। তুমি জানলে কি করে?
জানাটা কঠিন কিছু নয়। সাধারণ কয়েকটা ছিন্ন সুতো জোড়া দিয়েছি কেবল, জটিল করে কথা বলার সুযোগ পেলে সেটা ছাড়ে না কিশোর, যার সঙ্গেই বলুক।
হুঁ, চুপ করে গেলেন পরিচালক।
শুধু কুকুর নয়, স্যার, মনে হচ্ছে আরও ব্যাপার আছে। বলুন না?
আসলে, আমিই বিশ্বাস করছি না তো, তাই..ধরো, একটা জলজ্যান্ত ড্রাগন যদি চোখে পড়ে যায় হঠাৎ, মনের অবস্থাটা কেমন দাঁড়াবে?
গলা পরিষ্কার করে নিল কিশোর। ড্রাগন?
হ্যাঁ। আমার বন্ধুর বাড়ি সাগরের তীরে, পাহাড়ের ওপর। নিচে গুহা আছে। একটা বিশাল ড্রাগনকে সাগর থেকে উঠে এসে সেই গুহায় ঢুকতে দেখেছে সে।
স্তব্ধ হয়ে রইল তিন গোয়েন্দা।
এখন কি বলবে, বলো? আবার বললেন পরিচালক।
আমিই বিশ্বাস করতে পারছি না, তোমাদের কি করে করতে বলি? তা গিয়ে একবার দেখবে নাকি?