অস্বস্তি বোধ করছে মুসা। শুকনো ঠোঁটে জিভ বোলাল। পুরানো কাঠের সিঁড়ির রেলিঙ আঁকড়ে ধরে রেখেছে, ধীরে ধীরে বাড়ছে আঙুলের চাপ। কান খাড়া করে শুনছে।
রবিন আর কিশোরও কান খাড়া রেখেছে।
বড় ঢেউয়ের ভোঁতা গর্জন, আর ছোট ঢেউয়ের মোলায়েম হাসি ছাড়া আর কিছুই কানে আসছে না। না না, আসছে, যার যার বুকের ঢিপঢিপানি।
চলো, নামি, অবশেষে বলল মুসা। আল্লাহগো, তুমিই জানো।
কয়েক ধাপ নেমেই থেমে গেল কিশোর। পেছনে অন্য দু-জন।
কি হলো? ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করল মুসা।
সাগরের গর্জন একটু বেড়েছে না? বলল কিশোর।
কান পেতে ভালমত শুনল মুসা।
তার শ্রবণশক্তি অন্য দু-জনের চেয়ে জোরাল। কি জানি। সেরকমই তো লাগছে। হয়তো আমাদেরকে হুশিয়ার করছে ঢেউ।
সিঁড়ির ধাপগুলো অস্পষ্ট। মুখে কামড় মারছে যেন রাতের নোনা হাওয়া। ঠেলে বেরিয়ে রয়েছে পাহাড়ের চূড়া, চাঁদের আলোয় বিষণ্ণ ছায়া ফেলেছে বালিতে।
ওদের ভারে ভেঙে পড়ল না সিঁড়ির তক্তা। ভয় কাটল, পরের কয়েকটা ধাপ পেরোল দ্রুত। লাফিয়ে বালিতে নেমে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।
ওপরে তাকাল কিশোর। পাড়ের দু-একটা বাড়িতে এক-আধটা আলো জ্বলছে।
গুহামুখের কাছে এসে দাঁড়াল ওরা। কান পাতল শোনার জন্যে, ভালমত দেখল আশপাশটা। শব্দও নেই, কিছু চোখেও পড়ল না। গুহার ভেতরে নড়ছে না কিছু।
আবার ওপরে তাকাল কিশোর। ঠেলে বেরোনো চূড়ার জন্যে। পাড়ের ওপরের বাড়িঘর কিছু চোখে পড়ছে না। ভ্রুকুটি করল সে। এই যে না দেখা যাওয়ার ব্যাপারটা, এটাকে একটা পয়েন্ট বলে মনে হলো তার, কিন্তু কেন সেটা বুঝতে পারল না।
অবশেষে মাথা ঝাঁকাল সে, অল ক্লিয়ার।
নিঃশব্দে ভেতরে ঢুকে পড়ল ওরা। কান পাতল আবার কিশোর।
মুসার অবাক লাগছে। গেরিলা যোদ্ধার মত আচরণ করছে। গোয়েন্দাপ্রধান, যেন যে-কোন মুহূর্তে আক্রমণের ভয় করছে।
ব্যাপার কি? ফিসফিস করল মুসা। বিপদ আশা করছ?
সাবধানের মার নেই, ঘুরিয়ে জবাব দিল কিশোর। টর্চ জ্বালল মুসা। ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আলো ফেলে গুহাটা দেখতে শুরু করল। মাটিতে চোখ পড়তেই অস্ফুট শব্দ করে উঠল। বলল, আরি! ওখানেই শেষ হয়ে গেল গুহাটা, ওই যে, ওই গর্তের ওপারে। ডাইভার দু-জন তাহলে গেল কই?
আলো জ্বেলে কিশোরও দেখছে। গুহাটা এত ছোট হবে ভাবিনি। মুসা, ঠিকই বলেছ, ওরা গেল কই? কোন পথে?
গুহার দেয়াল পরীক্ষা করতে লাগল তিনজনে।
নিরেট, মাথা নাড়ল মুসা। নাহ্, মাথামুণ্ড কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।
কি বোঝা যাচ্ছে না? জিজ্ঞেস করল রবিন।
দেখছ না, কি ছোট গুহা? গর্তটাও ছোট। ড্রাগনের জায়গা হবে না।
বিস্ময় ফুটল কিশোরের চোখে। অথচ মিস্টার জোনস বললেন, চূড়ার নিচে এদিকেই কোথাও ড্রাগন ঢুকতে দেখেছেন। গর্তের পাড়ে দাঁড়িয়ে নিচে তাকাল সে। আর, ডাইভার দু-জনও বাতাসে মিলিয়ে যেতে পারে না। হয় ধারেকাছেই আরও গুহা আছে, কিংবা এই গুহারই আরও মুখ আছে। সুড়ঙ্গ আছে।
কিশোর! বলে উঠল রবিন। একটা কথা মনে পড়েছে।
দ্রুত জানাল সে, বইয়ে কি পড়েছে, আর বাবার মুখে কি কি শুনেছে।
চিন্তিত দেখাল কিশোরকে। সুড়ঙ্গ?
উত্তেজিত ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকাল রবিন। পাতাল রেলের জন্যে খোঁড়া হয়েছিল। কাজ শেষ হয়নি। এখনও আছে, ভূতুড়ে রেলপথ বলা যায়।
হুঁ! মাথা দোলাল কিশোর। কিন্তু কোথায় সেটা কে জানে। কয়েক মাইল দূরেও হতে পারে। এমনও হতে পারে, এখানেই এসে শেষ হয়েছে সুড়ঙ্গের মাথা, কিংবা এখান থেকেই শুরু হয়েছে।
কিশোর পাশাকে চমকে দেবে ভেবেছিল, কিন্তু হতাশ হতে হলো রবিনকে। হতে পারে।
খুঁজে বের করব রেলপথটা, কিশোর বলল। ম্যাপ পেলে ভাল হত। সী-সাইড সিটি প্ল্যানিং বোর্ড অফিসে গেলে হয়তো পাওয়া যাবে।
পঞ্চাশ-ষাট বছর পর? হেসে উঠল মুসা। যে এঁকেছিল, এতদিনে নিশ্চয় মরে ভূত হয়ে গেছে। আর ম্যাপটা থাকলেও চাপা পড়েছে পুরানো কাগজ আর বালির তলায়। খুঁজে পাওয়া যাবে না।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। হয়তো। এসো, এখন ম্যাপ ছাড়াই খুঁজে দেখি পাওয়া যায় কিনা।
এক কাজ করলে কেমন হয়? আজ সকালে তক্তার আড়ালে যে গুহাটা দেখেছি, ওটা থেকে শুরু করলে?
মন্দ বলনি, কিশোর বলল।
রবিনও একমত হলো।
গুহাটার কাছে চলে এল তিন গোয়েন্দা।
বালি সরাতেই বেরিয়ে পড়ল একটা বড় তক্তা। উত্তেজনায় জ্বলে, উঠল কিশোরের চোখ।
লক্ষ করল রবিন। গলা বাড়িয়ে দিল, কী?
ভুরু কুঁচকে গেছে কিশোরের। বুঝতে পারছি না এখনও। মনে হচ্ছে এটা প্লাইউড।
প্লাইউড? হলেই বা কি বুঝতে পারছে না রবিন।
আমার তাই বিশ্বাস। তক্তায় হাত বুলাচ্ছে কিশোর। এই রহস্যের সঙ্গে এর কি সম্পর্ক?…থাক, পরে ভাবব। আপাতত বালি সরাই, তক্তাগুলো যাতে সরানো যায়।
বালি সরিয়ে তক্তার গোড়া আলগা করে ফেলল ওরা। তক্তা সরিয়ে পথ করে সাবধানে ঢুকল সরু জায়গাটায়। আবার আগের জায়গায় লাগিয়ে রাখল তক্তা। টর্চ জ্বালল।
ছোট্ট একটা গুহা। নিচু ছাত। আর সামান্য নিচু হলেই সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারত না মুসা, মাথায় লাগত। ভেজা ভেজা। খানিক দূর এগিয়ে হঠাৎ ঢালু হয়ে মিশেছে উল্টোদিকের একটা পাথুরে তাকের সঙ্গে।
পথ নেই, বিড়বিড় করল মুসা।
চোর-ডাকাতের জন্যে চমৎকার লুকানোর জায়গা, বলল কিশোর। অতীতে নিশ্চয় খুব ব্যবহার হত। তক্তা যেভাবে লাগিয়েছে, বোঝাই যায়, গোপন কুঠুরী বানিয়েছিল এটাকে।