চুপ, ব্যাটা! কড়া ধমক লাগাল মুসা। তোকে কথা বলতে কে বলেছে? তুই কি তিন গোয়েন্দার কেউ? হারামীপনার আর জায়গা পাওনি, ব্যাটা। ভোট নিয়ে মস্করা করতে এসেছ। বেশি জ্বালাতন করলে খাঁচাসুদ্ধ নিয়ে গিয়ে ফেলে দিয়ে আসব গুহায়।
গ্রাহ্যই করল না ব্ল্যাকবিয়ার্ড। টেনে টেনে বলল, মরা মানুষ…মরা মানুষ। অ্যায়াম ব্ল্যাকবিয়ার্ড দ্য পাইরেট। হেহ হেহ হেহ্! তারপর মুখ খারাপ করে গাল দিল কয়েকটা, কান গরম করে দিল মুসার।
যা শোনে তাই মনে রাখে ব্যাটা, বলল রবিন। ওই যে শুনেছে, মরা মানুষ, ব্যস, আর ভুলবে না। চান্স পেলেই বলবে।
একদিন ওটার ঘাড় না মটকে দিয়েছি তো আমার নাম মুসা আমান নয়, ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলল মুসা। কিন্তু রবিন আর কিশোর জানে, তা সে কোনদিনই করবে না। তার অনুরোধেই পাখিটা রেখে দিয়েছে কিশোর, নইলে অন্যগুলোর সঙ্গে ওটাকেও দিয়ে আসত মিস কারমাইকেলের পাখির আশ্রমে। তবে বেশি জ্বালাতন করলে কিশোরের কথাও আর শুনবে না, ঠিকই চালান করে দিয়ে আসবে।
যাকগে। তো, এখন কি ঠিক হলো? আগের কথার খেই ধরল। কিশোর।
আমি যাচ্ছি না, মুসার সাফ জবাব।
কেন?
ভয় পাচ্ছি।
ভণিতা করছ তুমি, মুসা, হাসল কিলোর। এই সামান্য ব্যাপারে ভয় পাওয়ার ছেলে তুমি নও। মাঝে মাঝে তোমার সাহস দেখে আমারই তাক লেগে যায়। সেই আমাজনের জঙ্গলে…
ব্যস ব্যস, হয়েছে, আর ফোলাতে হবে না, হাত তুলল মুসা, যাব, যাও। মরলে তারপর দেখাব মজা…
মরলে তো মরেই গেলে, কিশোরের হাসি রবিনের মাঝেও সংক্রমিত হয়েছে। আর দেখাবে কি করে?
মরে গেলাম মানে? তোমরা মরবে না, যখনই মরো? আমি নরকে গেলে তোমরাও ওখানে যাবে। আগে মরলে বরং কিছু সুবিধে, শয়তানের সঙ্গে ভাব হয়ে যাবে আমার। তোমরা যখন যাবে তখন আমি অনেক পুরানো দোজখী, চোটপাট অনেক বেশি…
হয়েছে, হয়েছে, বাধা দিল কিশোর। তোমার চোটপাট বেশি হলেই আমাদের সুবিধে। নরকে সুযোগ-সুবিধা বেশি পাব। রিসিভারের দিকে হাত বাড়াল সে।
কাকে করবে? জিজ্ঞেস করল মুসা।
হ্যানসনকে। গাড়িটা দরকার। তোমার সম্মানার্থে আজ রোলস রয়েসে করেই যাব।
.
ঘণ্টাখানেক পর, গাড়ির জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রয়েছে মুসা।
রাজকীয় রোলস রয়েস। চকচকে কালো শরীরের ওপর সোনালী অলঙ্করণ, শত গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে গাড়িটার রূপ। শক্তিশালী বিশাল ইঞ্জিনের শব্দ প্রায় নেই বললেই চলে। উড়ে চলেছে যেন উপকূলের মহাসড়ক ধরে। দক্ষ, ভদ্র, খাঁটি ইংরেজ শোফারের হাতে পড়ে জীবন্ত হয়ে উঠেছে গাড়ি, তার প্রতিটি নির্দেশের সাড়া দিচ্ছে চোখের পলকে, বিন্দুমাত্র প্রতিবাদ না করে।
বাজিটা সেদিন তুমি না জিততে পারলেই বোধহয় ভাল হত, কিশোর, মুসা বলল। এই গাড়িটাই যত নষ্টের মূল। তিন গোয়েন্দা সৃষ্টিতে ওর মস্তবড় অবদান রয়েছে, অবশ্যই খারাপ অর্থে। কত বিপদে যে পড়লাম।
দোষটা কিশোরের চেয়ে অগাস্টের বেশি, মুসা, হেসে মনে করিয়ে দিল রবিন। বাজি জিতে তো মাত্র তিরিশ দিনের জন্যে পাওয়া গিয়েছিল গাড়িটা। কিন্তু অগাস্টই তো চিরকালের জন্যে বহাল করে দিল।
এবং সর্বনাশ করল আমাদের, ঘোঁৎ-ঘোৎ করল মুসা। নরম গদিতে আরাম করে হেলান দিয়ে হাসল। তবে এরকম গাড়িতে চড়ার আলাদা আনন্দ। আরামের কথা বাদই দিলাম, নিজেকে খুব হোমরা চোমরা মনে হয়। আহ, কোটিপতি ব্যাটারা কি মজায় না আছে।
সী-সাইডে পৌঁছল রোলস রয়েস। হ্যাঁনসনকে পথ বাতলে দিল কিশোর।
সাগরপাড়ে পৌঁছল গাড়ি।
আপনি এখানেই থাকুন, হ্যাঁ, শোফারকে বলল কিশোর। আমরা আসছি।
ভেরি গুড, মাস্টার পাশা, বিনয়ের চূড়ান্ত করে ছাড়ে হ্যাঁনসন, এত বেশি, একেক সময় কিশোরের লজ্জাই লাগে।
বড় বড় হেডলাইট দুটো জ্বেলে রেখেছে হ্যাঁনসন, তিন গোয়েন্দার হাঁটার সুবিধের জন্যে। হেডলাইট তো নয়, যেন সার্চলাইট, পথের ওপর ছড়িয়ে দিয়েছে তীব্র আলো।
নামল ছেলেরা। গাড়ির পেছনে গিয়ে বুট খুলল কিশোর।
টর্চ.ক্যামেরা:-টেপরেকর্ডার, নিতে নিতে বিড়বিড় করছে সে, নিজেকে বোঝাচ্ছে, জরুরী অবস্থার জন্যে তৈরি এখন আমরা। ডকুমেন্ট রাখতে পারব।
রেকর্ডারটা রবিনের হাতে দিল। ড্রাগন, কিংবা ভূতের যে শব্দই শোনো, রেকর্ড করবে। কিছুই বাদ দেবে না।
মুসার হাতে খুব শক্তিশালী একটা টর্চ দিল সে। আরেকটা দিল রবিনকে। নিজে রাখল একটা। এক বাণ্ডিল দড়ির ভেতরে হাত ঢুকিয়ে। দিয়ে কাঁধে ঝুলিয়ে নিল সেটা।
দড়ি কেন? জিজ্ঞেস করল মুসা।
কোটা যে কখন কাজে লাগবে কে জানে। তৈরি থাকা ভাল। একশো ফুট নাইলনের দড়ি আছে এখানে, হালকা, কিন্তু খুব শক্ত। একটা সিঁড়ি তো ভেঙেছে, আরেকটার কি অবস্থা কি জানি। যদি ওটাকেও ভেঙে পড়ার অবস্থা করে রাখে? দড়ি লাগবে না তখন? উঠে আসব কি বেয়ে?
আর কিছু বলল না মুসা।
গাড়ির আলোর সীমানা শেষ হলো। তারপর অন্ধকার পথটুকু চুপচাপ হাঁটল তিন গোয়েন্দা। দ্বিতীয় সিঁড়িটার কাছে এসে দাঁড়াল। প্রথমটা, ওই যেটা সকালে ভেঙে ছিল, সেটার কাছ থেকে কয়েকশো গজ দূরে দ্বিতীয়টা।
সবাই ঝুঁকে তাকাল নিচে। নির্জন সৈকত। হালকা মেঘের ফাঁকে লুকোচুরি খেলছে উঠতি চাঁদ। ঘোলাটে আলো ছড়িয়ে পড়েছে। বেলাভূমিতে। বালিয়াড়িকে একনাগাড়ে চুমু খাচ্ছে ছোট ছোট ঢেউ, তার মোলায়েম মৃদু হিসহিস শব্দ কানে আসছে। নিয়মিত সময় পর পর ছোট ঢেউয়ের মাথায় ভর করে যেন ছুটে আসছে পাহাড়-প্রমাণ বিশাল ঢেউ, আছড়ে পড়ে ভাঙছে তীরে, বিকট শব্দে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে হিসহিসানি, সামান্য বিরতি দিয়ে আবার শুরু হচ্ছে।