এই অবস্থা! অবাক হলো রবিন। বইটা লেখা হয়েছে অনেক আগে, প্রায় পঞ্চাশ বছর। তারমানে সী-সাইড মারা গেছে তারও আগে, অর্থাৎ পঞ্চাশ বছরের বেশি। ভাগ্যিস পেয়ে গিয়েছিল টেবিলের ওপর, নইলে শহরটার এই করুণ ইতিহাস হয়তো জানা হতো না কোন দিনই।
কিছু কিছু পয়েন্ট নোটবুকে টুকে নিয়ে বইটা তাকে তুলে রাখল সে। তারপর বসে বসে ভাবতে লাগল। কিশোরকে বলার মত অনেক কিছু জেনেছে, কিন্তু সেগুলো উগরানোর জন্যে অপেক্ষা করতে হবে। ছুটি হতে দেরি আছে।
সময় হলো। লাইব্রেরিয়ানকে গুডবাই জানিয়ে বেরিয়ে এল রবিন। সাইকেল চালিয়ে বাড়ি ফিরল। মা রাতের খাবার সাজাচ্ছেন। বাবা খবরের কাগজ পড়ছেন, মুখে পাইপ। রবিনের সাড়া পেয়ে মুখ তুলে হাসলেন। এই যে, রবিন, কি হয়েছিল তোমার? এত কাদা লাগল কোত্থেকে? ওয়াশিং মেশিনটা তো বাপ বাপ ডাক ছাড়ল ধুতে গিয়ে।
গর্তে পড়েছিলাম, বাবা। প্রথমে ভেবেছিলাম চোরাকাদা। পরে বুঝলাম, সাধারণ কাদা। তবে সাংঘাতিক আঠা।
কোথায় সেটা?
সী-সাইডে গিয়েছিলাম কেসের তদন্ত করতে। একটা গুহায় ঢুকলাম। অন্ধকারে কিছু দেখা যায় না। ঢুকেই পড়লাম গর্তের মধ্যে। চোরাকাদা ভেবে তো জানই উড়ে গিয়েছিল।
মাথা ঝাঁকিয়ে কাগজটা নামিয়ে রাখলেন মিস্টার মিলফোর্ড। হু, জায়গাটা খারাপই। সব ছিল চোর-ডাকাতের আড্ডা। লোকে তো ঢোকারই সাহস পেত না। শুনেছি অনেকেই নাকি ঢুকে আর বেরোতে পারেনি।
আমিও শুনেছি। লাইব্রেরিতে একটা বই পেয়ে গেলাম আজ হঠাৎ করে। জন্মেই নাকি মারা গেছে সী-সাইড, বেড়ে ওঠার আর সুযোগ পায়নি। তুমি কিছু জানো?
খবরের কাগজের লোক মিস্টার মিলফোর্ড, প্রচুর পড়াশোনা। রবিনের তো ধারণা, তার বাবা চলমান জ্ঞানকোষ।
আবার মাথা ঝাঁকালেন তিনি। হ্যাঁ। কত লোকের সর্বনাশ যে করেছে শহরটা। ওটার পেছনে টাকা খরচ করে ফকির হয়ে গিয়েছিল কত কোটিপতি, শেষে রুটি কেনার পয়সা পর্যন্ত জোটেনি। কপালই খারাপ ওদের, নইলে অ্যামিউজমেন্ট পার্কে আগুন লাগবে কেন? ওই হলো ধ্বংসের সূত্রপাত।
আমার কাছে কিন্তু এত খারাপ লাগল না শহরটা। বেশ বড়, প্রায় রকি বীচের সমান।
হাসলেন মিস্টার মিলফোর্ড। পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে হলে এ কথা বলতে পারতে না। শহর ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পর যারা তখনও টিকে রইল, তারা আবার ওটাকে গড়তে শুরু করল তিল তিল করে। অনেক পরিশ্রম আর আত্মত্যাগের পর আজ ওই অবস্থায় এসেছে। এখন আর পোড়া শহর বলে না কেউ, তবে স্বপ্ননগরীও আর হবে না কোনদিন। এখন ওটা কারখানা-শহর, টাকা কামানোর জায়গা।
যা দেখলাম-টেখলাম, কামানো বোধহয় খুব কঠিন। আচ্ছা, একটা আণ্ডারগ্রাউণ্ড রেলওয়ে তৈরি হওয়ার কথা নাকি ছিল ওখানে?
ছিল। সামনে ঝুঁকলেন মিস্টার মিলফোর্ড, স্বপ্ননগরী তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন একজন কোটিপতি। আর এই ভুলের জন্যে, শেষমেশ প্রাণ দিতে হয়েছিল তাকে। কাজটা শুরু করেই বোকা বনে গিয়েছিলেন ভদ্রলোক। বিশাল পরিকল্পনা। একচুমুকে যেন কোটি কোটি টাকা গিলে শেষ করে ফেলল পরিকল্পনার বিশাল দৈত্যটা। চোখের পলকে ফুরিয়ে গেল সব টাকা। এমনটা যে ঘটবে কল্পনাই করতে পারেননি তিনি। আশা করেছিলেন, শুরু করলে অনেকেই এগিয়ে আসবে সাহায্য করতে, কিন্তু এল না। পথের ফকির হয়ে শেষে আত্মহত্যা করতে হলো তাকে।
ঘনঘন বারকয়েক পাইপে টান দিয়ে ধোয়া ছাড়লেন তিনি। নামটা এখন মনে করতে পারছি না। শেষ মুহূর্তে যদি কিছু লোক বিশ্বাসঘাতকতা না করত, সী-সাইড সত্যি একটা দেখার মত শহর হত এখন…
বেরসিকের মত বাধা দিলেন মিসেস মিলফোর্ড, খাবার তৈরি।
আরও অনেক কিছু জানার ইচ্ছে ছিল রবিনের, কিন্তু হলো না। দেরি করলে মা রেগে যাবেন। উঠে বাবার পিছু পিছু খাবার টেবিলের দিকে এগোতে হলো তাকে।
এগারো
ডিনারের পর আবার হেডকোয়ার্টারে এসে ঢুকল তিন গোয়েন্দা।
আমি বলছিলাম কি, দৃঢ়কণ্ঠে বলল মুসা, মিস্টার জোনসের কুত্তা খোঁজার কাজটা আমাদের বাদ দেয়া উচিত। কি কাণ্ড! ভয়াবহ এক মানুষখেকো ড্রাগন, দু-জন শয়তান ডুবুরী-সঙ্গে আবার স্পীয়ারগান থাকে, লোকের গায়ে বর্শা গাঁথার জন্যে হাত নিশপিশ করে ওদের। মানুষ পেলেই গিলতে চায় যে কাদা-ভরা গর্তটা, ওটার কথা নাহয় বাদই দিলাম। আর পুরানো কাঠের সিঁড়ি, যেটা থেকে পড়ে কোমর ভাঙার জোগাড় হয়, ওটাও নাহয় ধরলাম না। বাড়িতে ফিরেও যন্ত্রণার কমতি নেই। ভূতুড়ে টেলিফোন আসে, গুহার কাছ থেকে দূরে থাকতে বলে। উপদেশটা খুব পছন্দ হয়েছে আমার।
ভূতুড়ে টেলিফোন? চোখ বড় বড় হয়ে গেল রবিনের।
তুমি যাওয়ার পর, কিশোর বলল, একটা ফোন এসেছিল। কি কি বলেছে, জানাল রবিনকে।
আমার কাছে ভোগলামী মনে হচ্ছে, শুকনো গলায় বলল রবিন।
কারও শয়তানী। সে চায় না, আমার গুহাটার কাছে যাই। না যাওয়াই বোধহয় ভাল।
যাব না মানে? গম্ভীর হয়ে গেল কিশোর, এখনও ড্রাগনটাকেই দেখিনি। ভাবছি, আজ রাতেই দেখতে যাব।
ভোটাভুটি হয়ে যাক তাহলে, প্রস্তাব দিল মুসা। আমি, না। কারও হ্যাঁ বলার থাকলে বলতে পারো।
হা! হা! হা! মাথার ওপরে ঝোলানো খাঁচা থেকে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠল ব্ল্যাকবিয়ার্ড, লঙ জন সিলভারের সেই ময়নাটা, রেখে দিয়েছে তিন গোয়েন্দা।