ফোন বেজে উঠল।
যন্ত্রটার দিকে তাকিয়ে রইল দু-জনে।
আবার রিঙ হলো।
মুসা জিজ্ঞেস করল, তুলব?
আমি তুলছি, রিসিভার তুলল কিশোর। স্পীকারের সঙ্গে যোগাযোগের সুইচ অন করে দিয়ে বলল, হ্যালো।
জবাব নেই।
আবার বলল, হ্যালো?
জবাব নেই।
রঙ নাম্বার-টাম্বার হবে, মন্তব্য করল মুসা।
আমার মনে হয় না। জবাব তো দেবে-..
অদ্ভুত একটা শব্দ শোনা গেল স্পীকারে, ঘড়ঘড়ে, গলা টিপে ধরে ঠিকমত শ্বাস নিতে দেয়া হচ্ছে না যেন, অনেক কষ্টে দম টানছে
বেচারা। তা ধীরে ধীরে বদলে গেল ঘড়ঘড়ানি, কথা ফুটল। কোনমতে উচ্চারণ করল একটা মাত্র শব্দ, দূরে…!
তারপর আবার শুরু হলো ঘড়ঘড়ানি। অনেক কষ্টে যেন গলা থেকে আঙুলের চাপ সামান্য শিথিল করে আবার বলল, দূরে দূরে থাকবে…! জোরে জোরে শ্বাস টানল।
কি করে থাকব? গলা চড়িয়ে জিজ্ঞেস করল কিশোর।
আমার…গুহা…! আবার ঘড়ঘড়ানি, আগের চেয়ে বেড়েছে। শ্বাসকষ্ট, মৃত্যুযন্ত্রণা শুরু হয়েছে বুঝি।
কে বলছেন? উত্তেজনায় রিসিভার-ধরা হাত কাঁপছে কিশোরের।
স্পীকারে ভেসে এল কাঁপা কাঁপা কণ্ঠস্বর, যেন বহু দূর থেকে, মরা…মানুষ…! অনেক দিন আগে মরে যাওয়া একজন…গুহায় আটকে রেখে খুন করা হয়েছিল আমাকে…?
কাঁপা দীর্ঘ ঘড়ঘড়ানি, ফিসফাস হলো কিছুক্ষণ, তারপর নীরব হয়ে গেল।
আস্তে করে রিসিভার নামিয়ে রাখল কিশোর। দু-জনেই চেয়ে রইল যন্ত্রটার দিকে।
হঠাৎ উঠে দাঁড়াল মুসা। আমি যাই। মা বলে দিয়েছে সকাল সকাল বাড়ি ফিরতে, জরুরী কাজ আছে। ভুলেই গেছিলাম।
যাবে? নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর।
হ্যাঁ, যাই, দুই সুড়ঙ্গের ঢাকনার দিকে এগোল মুসা। কিশোরকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে নেমে পড়ল সুড়ঙ্গে।
ভূতের ভয়ে পালাচ্ছে মুসা, বুঝল কিশোর। সে ভয় পায়নি, কিন্তু অবাক হয়েছে খুব। বিড়বিড় করল, দূরে থাকবে…আমার গুহা…
মিস্টার জোনস বলেছিলেন, ড্রাগন দেখেছেন। সাগর থেকে উঠে দানবটাকে গুহায় ঢুকতে দেখেছেন। কিন্তু কই, কোন ভূতের কথা তো বলেননি?
একা একা বসে থাকতে ভাল লাগল না তার। ফোঁস করে একটা নিঃশ্বাস ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে-ও।
দশ
গোসল সেরে, কাপড় বদলে, হালকা খাবার খেয়ে অনেকটা ভাল বোধ। হলো রবিনের। রকি বীচ পাবলিক লাইব্রেরিতে চলল, পার্ট টাইম চাকরিতে।
রবিনকে ঢুকতে দেখে মুখ তুলে তাকালেন লাইব্রেরিয়ান, হাসলেন। এই যে, রবিন, এসেছ। খুব ভাল হয়েছে। সাংঘাতিক ভিড় আজ, কুলিয়ে উঠতে পারছি না। অনেক বই ফেরত এসেছে, রীডারও বেশি। ওই দেখো, কত বই নিচে জমে আছে। তাকে তুলে দেবে, প্লীজ?
এখুনি দিচ্ছি, বলে বইয়ের স্তূপের দিকে এগোল রবিন।
ফেরত আসা বইগুলো এক এক করে তাকে সাজিয়ে রাখতে লাগল সে। সেগুলো ভোলা শেষ করে চোখ ফেরাল রীডিং রুমের দিকে। টেবিলে অনেক বই জমে আছে। তুলতে শুরু করল। হঠাৎ একটা বইয়ের মলাটে দৃষ্টি আটকে গেল তার। নামটা নজর কেড়েছে:
লিজেন্ডস অভ ক্যালিফোর্নিয়া আনমনে বইটা হাতে নিয়ে পাতা ওল্টাতে লাগল। দৃষ্টি আটকে গেল আবার বইয়ের একটা অধ্যায়ে:
সী-সাইড: ড্রীম অভ আ সিটি দ্যাট ডাইড
হুমম, আপন মনে মাথা দোলাল রবিন, ইনটারেসটিং!
বইটা একপাশে সরিয়ে রাখল সে। বেশ ভাল একটা লেখা পেয়ে গেছে। পড়ার জন্যে আকুল হয়ে উঠল মন, কিন্তু আগে কাজ শেষ করতে হবে। তাড়াহুড়ো করে বই তুলতে লাগল।
বই তোলা শেষ হলে তাকে ডাকলেন লাইব্রেরিয়ান। কয়েকটা বইয়ের মলাট, পাতা ছিঁড়ে গেছে, আঠা দিয়ে ওগুলো জোড়া দিতে বললেন।
পেছনের একটা ঘরে সমস্ত সরঞ্জাম রয়েছে। বইগুলো তুলে নিয়ে সেখানে চলে এল রবিন। খুব দ্রুত হাত চালাল। কিন্তু কাজটা সহজ নয়, সময় লাগলই।
মেরামত সেরে সেগুলো নিয়ে আবার লাইব্রেরিয়ানের কাছে ফিরে এল সে। হয়ে গেছে। আর কিছু?
হাসলেন লাইব্রেরিয়ান। খুব তাড়া আছে মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ, একটা বই পেয়েছি, হেসে বলল রবিন।
আর থাকতে পারছ না, না? হাসলেন লাইব্রেরিয়ান। নাহ, আপাতত আর কিছু নেই। যাও, পড়োগে। দরকার হলে ডাকব।
তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে পড়ার টেবিলে চলে এল রবিন।
অধ্যায়টা চিহ্ন দিয়েই রেখেছিল। খুলে পড়তে শুরু করল:
দুর্ভাগ্যের শিকারে পরিণত হয়, এমন অনেক শহর আছে। শহরের সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোর বাসিন্দাদের ভাগ্যেও নেমে আসে অমঙ্গল। সী সাইডের অবস্থাও হয়েছে তাই। কী রিসোর্ট কমিউনিটি হওয়ার কথা ছিল ওটার, কিন্তু সে-স্বপ্ন নস্যাৎ হয়ে গেছে পঞ্চাশ বছর আগে।
ঝলমলে যে কর্মব্যস্ত শহরের কল্পনা করেছিল এর পরিকল্পনাকারীরা, তাদের সর্বস্ব বাজি ধরেছিল এর পেছনে, কার্যকর হয়নি। তারা কল্পনা করেছিল, ভেনিস নগরীর মত এটাতেও জালের মত বিছিয়ে থাকবে খাল আর প্রণালী। কিন্তু তাদের আশাকে দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে গড়ে উঠল অসংখ্য কারখানা। একদা রমরমা হোটেলগুলোর কিছু পরিবর্তিত হয়ে গেল বোর্ডিং হাউসে, বাকিগুলো সব প্রাণ দিল বুলডোজারের কঠিন চোয়ালে-উত্তর-দক্ষিণে চলে যাওয়া সুবিশাল মহাসড়ককে জায়গা ছেড়ে দেয়ার জন্যে।
সী-সাইডের সবচেয়ে তিক্ত ঘটনা সম্ভবত এর ভূগর্ভ রেলওয়ে তৈরির ব্যর্থতা। পশ্চিম উপকূলে পাতালরেল ওটাই প্রথম তৈরি হওয়ার কথা ছিল। ব্যর্থতার একটা মূল কারণ, সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিশেষ সাড়া মেলেনি। ফলে শুরুতেই থেমে গেল কর্মব্যস্ততা, কয়েক মাইল সুড়ঙ্গ তৈরি হলো বটে, কিন্তু ওই পর্যন্তই। পরিত্যক্ত হতে সময় লাগল না। ভূতুড়ে সুড়ঙ্গ এখন ওটা।