কাঠের ভারে পিছলে যাচ্ছি, ব্যালান্স রাখতে পারছি না। কাঠ না ছাড়লে আমিও পড়ব গর্তে। সাংঘাতিক নরম বালি…
আর কিছু শোনার অপেক্ষা করল না মুসা। লাফিয়ে উঠে বিপজ্জনক কিনার ধরে প্রায় ছুটে চলে এল কিশোরের কাছে। ঝাঁপিয়ে পড়ল তার ওপর। উপুড় হয়ে শুয়ে কিশোরের পা ধরে টেনে সরিয়ে আনল খানিকটা। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, এবার পারবে?
থ্যাংক ইউ, কিশোরের কণ্ঠও কাঁপছে। পা ছেড়ো না। কাঠটা আবার ঢোকাচ্ছি আমি। বড় বাঁচা বেঁচেছি। আরেকটু হলেই আমিও গিয়েছিলাম… কাঠটা আবার ঠেলে দিল সে। গর্তের দেয়ালে ঠেকতেই হ্যাঁচকা ঠেলা দিয়ে ঢুকিয়ে দিল কয়েক ইঞ্চি। জোরে জোরে শ্বাস নিল কয়েকবার।
মুসা জিজ্ঞেস করল, কি হলো, পারছ না?
হ্যাঁ, দেয়ালে ঠেকেছে।
আমি ধরে আছি, ছাড়ব না। তুমি ঠেলো।
জোরে জোরে কয়েকটা হ্যাঁচকা ঠেলা দিয়ে কাঠের মাথা অনেকখানি গর্তের দেয়ালে ঢুকিয়ে দিল কিশোর। ডেকে বলল, রবিন, দেখো এবার। ঝুলে ঝুলে আসবে, আস্তে আস্তে হাত সরাবে, একটুও তাড়াহুড়ো করবে না। কাঠ ভাঙলে সর্বনাশ!
কাঠের মৃদু কড়মড় প্রতিবাদ শুনেই বোঝা গেল উঠে আসছে রবিন। কতক্ষণ সইতে পারবে কে জানে।
আসছে, না? জানতে চাইল মুসা।
হ্যাঁ, বলল কিশোর। পা ছেড়ো না আমার। কখন কি হয় বোঝা যাচ্ছে না। গর্তের ভেতরে হাত আর মাথা ঢুকিয়ে দিল সে, বিপজ্জনক ভঙ্গিতে ঝুলে পড়ল, রবিন নাগালের মধ্যে এলেই যাতে টেনে তুলতে পারে।
গুঙিয়ে উঠল রবিন। কিশোর, আর পারছি না! ইস, এত পিছলা! খালি হাত পিছলে যায়!
আমার হাত দেখতে পাচ্ছ? জিজ্ঞেস করল কিশোর।
পাচ্ছি। আর তিন-চার ফুট উঠতে পারলেই ধরতে পারব। কিন্তু পারছি না তো।
চুপ! তাড়াহুড়ো কোরো না। জোরে জোরে হাঁপাচ্ছে কিশোর। আনমনে বলল, ইস, একটা দড়ি যদি পেতাম।
দড়ি পাবে কোথায়? পেছন থেকে বলল মুসা।
কিশোর, আর পারছি না! নিচে থেকে ককিয়ে উঠল রবিন। হাত ছিঁড়ে যাচ্ছে!
আরেকটু ধরে থাকো। মুসা, আরও শক্ত করে ধরো।
অনেক কায়দা কসরত করে কোমর থেকে বেল্টটা খুলে ফেলল কিশোর। বাকসের ভেতর চামড়ার ফালিটা ঢুকিয়ে ছোট একটা ফাঁস বানাল। তারপর মাথা ধরে ঝুলিয়ে দিল নিচে। রবিন, দেখতে পাচ্ছ?
হ্যাঁ হ্যাঁ, পাচ্ছি।
ফাঁসের মধ্যে হাত ঢোকাও।
আস্তে করে কাঠ থেকে একটা হাত সরিয়ে ফাঁসের মধ্যে ঢোকাল রবিন। আরেক হাতে অনেক কষ্টে ঝুলে রইল। পিছলে সরে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে।
টান দিয়ে তার হাতে ফাঁসটা আটকে দিল কিশোর। মুসা, টানো। টেনে টেনে পেছনে সরাও আমাকে।
ব্যথা পাবে তো।
আরে, রাখো তোমার ব্যথা। টাননা।
টানতে শুরু করল মুসা। দু-হাতে বেল্টের একমাথা ধরে রেখেছে। কিশোর। ঘামে ভিজে পিছল হয়ে গেছে হাতের তালু, বেল্টটা না ছুটলেই হয় এখন।
অবশেষে গর্তের বাইরে বেরিয়ে এল রবিনের হাত। মাথা বেরোল। উঠে এল সে।
থামল না মুসা। টেনে আরও সরিয়ে আনল কিশোরকে, সেই সঙ্গে রবিনকে। যখন বুঝল আর ভয় নেই, কিশোরের পা ছেড়ে দিয়ে ধপ করে বসে পড়ল। আরিব্বাপরে, কি একখান টাগ অভ ওয়ার গেল!
হাঁপাচ্ছে কিশোর আর রবিন, ঘড়ঘড় শব্দ বেরোচ্ছে গলা থেকে।
রবিনের গায়ে হাত রাখল কিশোর, ইস, এত পিছলা। কাদায় গড়িয়ে ওঠা শুয়োরও তো এত পিচ্ছিল না।
তিনজনেই হাসল।
আট
বন্ধুদেরকে বার বার ধন্যবাদ জানাল রবিন। মুখের কাদা মুছে বলল, কিশোর, ঠিকই বলো তুমি, বিপদে মাথা গরম করতে নেই। তোমার ঠাণ্ডা মাথাই আজ আমার প্রাণ বাঁচিয়েছে।
সব ভাল যার শেষ ভাল, মুসা বলল। তো, এখন কি করব?
বাড়ি ফিরব, সঙ্গে সঙ্গে বলল কিশোর। গোসল করে কাপড় বদলানো দরকার, বিশেষ করে রবিনের। নিশ্চয় খুব অসুবিধে হচ্ছে ওর। সব দোষ আমার। টর্চ না নিয়ে অন্ধকারে গুহা দেখতে এসেছি, গর্দভের মত কাজ করেছি।
আমারই দোষ, রবিন বলল। তুমি তো হুঁশিয়ার থাকতে বলেইছিলে। আমি গাধার মত ছুটে গিয়ে পড়েছি গুহায়। এত তাড়াহুড়ো না করলেই তো পড়তাম না।
উঠে দাঁড়াল কিশোর। চিন্তিত কণ্ঠে বলল, গুহামুখের অত কাছে এমন একটা গর্ত, কৌতূহলী লোককে ঠেকানোর ভালই ব্যবস্থা! দূরে সরিয়ে রাখবে!
খাইছে! হঠাৎ কি মনে পড়ে যাওয়ায় বলে উঠল মুসা, হয়তো কুত্তাগুলো সব গিয়ে পড়েছে ওই গর্তে, চোরাকাদায় ডুবে মরেছে।
কিশোর বলল, হতে পারে। কিন্তু ঢোকার আগেই ভালমত দেখেছি আমি। কুকুরের পায়ের ছাপ তো চোখে পড়ল না।
হুঁ! যাকগে, ওসব পরে ভাবা যাবে। চলো, বেরোই। জায়গাটা মোটেও পছন্দ হচ্ছে না আমার। ভয় ভয় করছে।
তিনজনেই একমত হলো এ-ব্যাপারে।
গর্তের কাছ থেকে সরে এল ওরা।
তখন উত্তেজনা আর তাড়াহুড়োয় খেয়াল করেনি কিশোর, এখন দেখল, গুহামুখের উল্টো দিকে বড় বড় পাথরের চাই। আরেকটা সুড়ঙ্গমুখ দেখা যাচ্ছে। কদ্দূর গেছে কে জানে, আপনমনে বিড়বিড় করল সে। চোর-ডাকাত আর চোরাচালানীর আখড়া ছিল তো শুনলাম।
সে তো ছিলই, জোর দিয়ে বলল মুসা। কিন্তু তাতে কি?
দেখে কিন্তু সেরকম মনে হয় না। এতবেশি খোলামে, ঢোকা আর বেরোনো খুব সহজ, একটু সাবধানে চললেই বিপদ এড়ানো সম্ভব।
আরও সুড়ঙ্গ-টুড়ঙ্গ আছে হয়তো, রবিন বলল। নরম মাটিকে ক্ষয় করে ফেলে পানির স্রোত, ধুয়ে নিয়ে যায়, অনেক সুড়ঙ্গ তৈরি হয়। তবে তাতে সময় লাগে, অনেক ক্ষেত্রে লাখ লাখ বছর। মনে হচ্ছে, অনেক আগে এই জায়গাটাও পানির তলায় ছিল। যদি তাই হয়, আরও অনেক সুড়ঙ্গ আছে এখানে।