কান খাড়া করল সে। দেখি তো ডেকে, রবিনের সাড়া আসে কিনা। ওর কথার প্রতিধ্বনি শুনলেই আন্দাজ করতে পারব, গুহাটা কত বড়। চেঁচিয়ে ডাকল, রবিন? কি দেখছ?
মুসাও কান খাড়া করে ফেলেছে।
শব্দটা শুনতে পেল দু-জনেই। বিচিত্র একটা শব্দ, কিসের বোঝা গেল না।
পরক্ষণেই ভেসে এল রবিনের চিৎকার, তীক্ষ্ণ, আতঙ্কিত। তারপর একটি মাত্র শব্দ: বাঁচাও!
সাত
চোখ বড় বড় করে আবছা অন্ধকার গুহার ভেতরে তাকিয়ে রয়েছে কিশোর আর মুসা, কি করবে বুঝতে পারছে না। এই সময় আবার শোনা গেল রবিনের চিৎকার।
বাঁচাও! আমাকে বাঁচাও!
বিপদে পড়েছে! চেঁচিয়ে উঠল মুসা। এসো। ছুটে সুড়ঙ্গের ভেতরে ঢুকে গেল সে।
তাকে অনুসরণ করতে কষ্ট হচ্ছে কিশোরের। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, আরেকটু আস্তে, মুসা। ও বেশি দূরে নয়, হুঁশিয়ার থাকা দরকার…
কথা শেষ করতে পারল না কিশোর, মুসার গায়ে এসে পড়ল। বাড়ি খেয়ে হুক করে সমস্ত বাতাস বেরিয়ে গেল তার ফুসফুস থেকে। পড়তে পড়তে কোনমতে সামলে নিল।
কানে এল মুসার গলা, সরো, কিশোর, সরে যাও! ও এখানেই!
কোথায়? কই, আমি তো কিছুই দেখছি না।
চোখ মিটমিট করল কিশোর। চোখে সয়ে এল আবছা আলো। তার সামনেই চার হাত-পায়ে ভর রেখে উপুড় হয়ে রয়েছে মুসা।
আরেকটু হলেই গেছিলাম গর্তে পড়ে, বলল সে। রবিন ওতেই পড়েছে।
কই? মুসার কাঁধের ওপর দিয়ে দেখার চেষ্টা করল কিশোর। রবিন, কোথায় তুমি?
এত কাছে থেকে শোনা গেল রবিনের কণ্ঠ, চমকে উঠল কিশোর। এই যে, এখানে! চটচটে কিছু! খালি নিচে টানছে!
ইয়াল্লা! চিৎকার করে বলল মুসা। চোরাকাদা!
অসম্ভব! এই জরুরী মুহূর্তেও যুক্তির বাইরে গেল না গোয়েন্দাপ্রধান। সাধারণত গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চল ছাড়া চোরাকাদা দেখা, যায় না। মুসার পাশ দিয়ে ঘুরে এসে কিনারে বসল, সাবধানে হাত নামিয়ে দিল নিচে। কই, দেখছি তো না। রবিন, আমাদের দেখছ?
হ্যাঁ! এই তো, তোমাদের নিচেই।
নিচু হয়ে হাত আরেকটু নামাল কিশোর। আমি দেখছি না। রবিন, ধরো, আমার হাতটা ধরো। আমি আর মুসা টেনে তুলব।
নিচে আঠাল তরলে নড়াচড়ার ফলে চপচপ শব্দ হলো। পারছি না।…নড়লেই ডুবে যাচ্ছি আরও। নাগাল পাচ্ছি না।
হাতের ডাণ্ডাটা আছে তোমার? মুসা জিজ্ঞেস করল। ওই দাঁড়ভাঙাটা। থাকলে…
নেই! প্রায় ককিয়ে উঠল রবিন। পড়ে গেছে!
নিজের হাতের কাঠটায় মুঠোর চাপ শক্ত হলো মুসার। আমারটাও এত শক্ত না। ভার সইবে না, ভেঙে যাবে। গোঙানির মত একটা শব্দ করল সে।
শুঁয়োপোকার মত কিলবিল করে গর্তের ধারে হামাগুড়ি দিতে শুরু করল কিশোর। রবিন, চুপ করে থাকো, নোড়ো না। গর্তটা কত বড়, বুঝে নিই।
জলদি করো। কেঁদেই ফেলবে যেন রবিন। তোলো আমাকে। গর্ত মাপার সময় নয় এটা।
খুব ধীরে ধীরে এগোচ্ছে কিশোর। মাপতেই হবে। এ ছাড়া তোমাকে তুলে আনার আর কোন উপায় দেখছি না।
অন্ধকারে খুব সাবধানে গর্তটার চারধারে ঘুরল কিশোর, হুশিয়ার থাকা সত্ত্বেও কিনারের মাটি ভেঙে ঝুরঝুর করে পড়ল ভেতরে। আরে, করছ কি! নিচ থেকে চেঁচিয়ে উঠল রবিন। ভূমিধস নামাবে নাকি?
সরি। কিনারে আলগা মাটি, হাত লাগলেই পড়ে যাচ্ছে।
মুসার গায়ে হাত পড়তেই বুঝল কিশোর, গর্ত ঘোরা শেষ হয়েছে। থামল। মুসা, মনে হয় পারব। রবিন, তোমার পা কি তলায় ঠেকেছে? বুঝতে পারছ কিছু?
আরেকবার চপচপ করে উঠল আঠাল তরল। না, তিক্ত শোনাল রবিনের কণ্ঠ। একটু নড়াচড়ায়ই আরও অনেকখানি তলিয়ে গেছি। দোহাই তোমাদের, কিছু একটা করো! তোলো আমাকে! তোমার হিসেবনিকেশটা পরে কোরো, কিশোর!
মুসা বলল, কিশোর, আমার পা শক্ত করে ধরতে পারবে? আমি গর্তের ভেতর পেট পর্যন্ত ঢোকাতে পারলেই ওকে তুলে আনতে পারব।
মাথা নাড়ল কিশোর, অন্ধকারে মুসা সেটা দেখতে পেল না।
আমার কাঠটা ব্যবহার করতে পারি, কিশোর বলল।
টেনে তোলা যাবে না। গর্তের কিনারে আলগা নরম বালি, ভার রাখতে পারবে না, চাপাচাপি করলে দেবে যাবে। তবে, কাঠটা আড়াআড়ি গর্তের ওপর রাখা যায়, দু-মাথা গর্তের কিনারে মোটামুটি ভালই আটকাবে।
তাতে লাভটা কি? রবিন তো নাগাল পাবে না।
মনে হয় পাবে, যদি কোনাকুনি ঢুকিয়ে দিই। কি করব, বুঝতে পারছ তো? একমাথা গর্তের ভেতরে কোনাকুনি ঢুকিয়ে ঠেসে ঢোকাব দেয়ালে। নরম মাটিতে ঢুকে যাবে সহজেই। আরেক মাথা থাকবে ওপরে, কিনারে শক্ত করে চেপে ধরব। সিঁড়ি তৈরি হয়ে যাবে…
ঠিক বলেছ! জলদি করো, জলদি…
বেশি আশা করতে পারল না কিশোর, পাতলা কাঠ। ভার সইতে পারলে হয়। তবু, দেখা যাক চেষ্টা করে।…রবিন, তোমার মাথার কাছে। দেয়ালে ঢোকানোর চেষ্টা করছি। খুব সাবধানে উঠবে। পিছলালে কিন্তু মরবে। কাঠটা ভেঙে গেলেও…খুব সাবধান।
জলদি করো! আরও ডুবেছি! গলা কাঁপছে রবিনের।
দ্রুত গর্তের অন্য ধারে চলে এল কিশোর, মুসা যেখানে রয়েছে তার উল্টো দিকে। লম্বা হয়ে শুয়ে কাঠটা ঠেলে দিল গর্তের ভেতরে। আস্তে আস্তে, এক ফুট এক ফুট করে।
হঠাৎ নিচ থেকে রবিনের চিৎকার শোনা গেল, আরেকটু, আরেকটু ঠেলে দাও, ধরতে পারছি না।
আরও কয়েক ইঞ্চি ঠেলে দিল কিশোর।
আরও একটু, নিচে থেকে বলল রবিন। এই আর কয়েক ইঞ্চি।
কাঠটা আরেকটু আসার অপেক্ষা করছে রবিন। এল না। তার বদলে শুনল ওপরে কিশোরের চাপা গলা, অস্ফুট একটা শব্দ। কি হলো, কিশোর?