মাটিতে বসল একটা পাখি। সেটা দেখিয়ে মুসা বলল, চলো না, ওকে জিজ্ঞেস করি, ড্রাগন দেখেছে কিনা? অনেক কষ্ট বাঁচবে তাহলে আমাদের।
ভাল বলেছ, মুসার রসিকতায় হাসল রবিন। ও না বললে ওই টাগবোটের মাঝিদেরকে জিজ্ঞেস করব।
মাইলখানেক দূরে একটা বার্জকে টেনে নিয়ে চলেছে একটা টাগবোট, স্যালভিজ রিগ-জাহাজ কোন দুর্ঘটনায় পড়লে উদ্ধার করা ওগুলোর কাজ।
তাড়াহুড়ো আছে বলে তো মনে হচ্ছে না, মুসা বলল। দেখছ না কি রকম ধীরে ধীরে চলছে। ড্রাগন শিকারে বেরিয়েছে কিনা কে জানে। হাহ্ হাহ্।
টিটকারিতে কান দিল না কিশোর। গুহা আর পানির সঙ্গে একটা কল্পিত সরলরেখা বরাবর দৃষ্টি, একবার এপাশে তাকাচ্ছে, একবার ওপাশে। কি যেন বোঝার চেষ্টা করছে। অবশেষে বলল, এই এলাকায়ই কোথাও ড্রাগনের পায়ের ছাপ মিলবে। একসঙ্গে না থেকে ছড়িয়ে পড়ো।
আলাদা আলাদা হয়ে তিনদিকে ছড়িয়ে হাঁটতে লাগল ওরা। নিচে বালির দিকে চোখ। ড্রাগনের চিহ্ন খুঁজছে।
কি আর দেখব? একসময় বলল রবিন। খালি আগাছা।
আমিও তাই বলি, মুসা বলল। তবে কিছু শামুক আর ভেসে আসা কাঠ আছে। ড্রাগনের এ সব পছন্দ কিনা বুঝতে পারছি না।
খানিকক্ষণ পর পর মাথা নাড়ল রবিন। কিছু নেই। কিশোর, জোয়ারের পানিতে মুছে যায়নি তো?
নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটছে কিশোর। আনমনে বলল, হয়তো এখানে, পানির ধারে…না না, ওখানে…শুকনো বালি..গুহামুখ পর্যন্ত রয়েছে। থাকলে ওখানে থাকবে।
ধরো, মুসা বলল, ড্রাগনটা গুহায় বসে আছে। কি করব আমরা তাহলে? লড়াই করব ওর সঙ্গে? খালি হাতে? আদ্যিকালের রাজকুমারদের কাছে তো তবু জাদুর তলোয়ার থাকত…
কারও সঙ্গে লড়াই করতে আসিনি আমরা, মুসা, গম্ভীর হয়ে বলল কিশোর। সাবধানে গুহার মুখের কাছে এগিয়ে যাব। ভেতরে বিপদ নেই এটা বুঝলেই কেবল গুহায় ঢুকব।
কুটি করল মুসা। নিচু হয়ে একটা কাঠ তুলে নিয়ে বলল, যত যা-ই বলল, খালি হাতে ঢুকতে আমি রাজি না। মরি আর বাঁচি, একখান বাড়ি তো মারতে পারব।
হেসে ফেলল কিশোর।
রবিন আরেকটা কাঠ তুলে নিল। নৌকার একটা দাঁড়, আধখানা ভেঙে গেছে। ঠিকই বলেছে মুসা। সেইন্ট জর্জ অ্যাণ্ড দ্য ড্রাগন ছবিটা দেখেছি। তলোয়ার দিয়ে কিভাবে ড্রাগনকে খোঁচা মেরেছে মনে আছে। আমরা অবশ্য খোঁচা মারতে পারব না, তবে দু-জনে মিলে পেটালে ভড়কে গিয়ে পালিয়েও যেতে পারে। পুরানো আমলের জন্তু তো, নতুন আমলের মানুষকে ভয় না পেয়েই যায় না।
কিশোরের দিকে তাকাল সে। তুমি কিছু নিলে না? ভাঙা রেলিঙটা এনে দেব? বড় বড় পেরেক বসানো আছে মাথায়, দেখেছি, চোখা কাঁটা বেরিয়ে আছে। ড্রাগনকে আঁচড়ে দিতে পারবে।
হেসে বলল কিশোর, তা মন্দ বলোনি। হাতে করে একটা লাঠিটাটি নিয়েই নাহয় গেলাম। রেলিঙের দরকার নেই। লম্বা ভেজা একটা তক্তা তুলে নিয়ে কাঁধে ফেলল সে, যেন তলোয়ার নিয়ে চলেছে। গর্বিত রাজকুমার। তারপর হাঁটতে শুরু করল বন্ধুদের পাশে পাশে।
গুহামুখের দিকে এগিয়ে চলেছে তিন ড্রাগন-শিকারী। মুখে যতই বড় বড় কথা বলুক, গুহাটার কাছাকাছি এসে কিশোরের বুকের ধুকপুকানিও বাড়ল।
হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল সে। শুকনো বালির দিকে আঙুল তুলে বলল, দেখো দেখো!
মুসা আর রবিনও দেখল। নরম বালি বসে গেছে এক জায়গায়, গভীর দাগ।
নতুন প্রজাতির ড্রাগন নাকিরে বাবা? নিচু কণ্ঠে বলল রবিন। পায়ের ছাপ তো নয়, যেন ঘোড়া গাড়ির চাকা।
মাথা ঝাঁকাল কিশোর। তারপর তাকাল পানির দিকে, দু-দিকের সৈকতও দেখল। কোন গাড়ি-টাড়ি তো দেখছি না। তবে চাকার দাগ যে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। বীচ-বাগি হতে পারে, লাইফ-গার্ডদের। পেট্রলে এসেছিল এদিকে।
হয়তো, মেনে নিতে পারছে না রবিন। কিন্তু তাই যদি হবে, তাহলে তো চাকার দাগ পড়বে উত্তর-দক্ষিণে, সৈকতের একদিক থেকে আরেক দিকে। অথচ এটা গেছে গুহার দিকে।
কারেক্ট, আঙুলে চুটকি বাজাল কিলোর। বুদ্ধি খুলছে। হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল দাগ পরীক্ষা করার জন্যে।
পানির দিকে ফিরল রবিন। পানির কাছে গিয়ে দেখে এলে কেমন হয়?
ওখানে বোধহয় পাবে না, কিশোর বলল। ঢেউয়ের জোর বেশি, জোয়ারের পানিতে মুছে গিয়ে থাকতে পারে।
মুসা বলল, মিস্টার জোনসের বুড়ো চোখের ওপর ভরসা করা যাচ্ছে না আর। কি দেখতে কি দেখেছেন, কে জানে। জীপের সার্চলাইটকেই হয়তো ড্রাগনের চোখ ভেবেছেন, ইঞ্জিনের শব্দকে ড্রাগনের গর্জন।
তা-ও হতে পারে। তবে আগে থেকেই এত অনুমান করে লাভ নেই। গুহায় ঢুকে ভালমত দেখা দরকার।
গুহামুখের গজ দশেক দূরে হঠাৎ করে শেষ হয়ে গেল দাগ। সামান্যতম চিহ্নও নেই আর।
একে অন্যের দিকে তাকাল ছেলেরা।
আশ্চর্য! বিড়বিড় করল মুসা।
গুহামুখে পৌঁছে ভেতরে উঁকি দিল ওরা। শূন্য মনে হচ্ছে।
ড্রাগন তো ড্রাগন, আস্ত বাস ঢুকে যেতে পারবে এই মুখ দিয়ে, ওপর দিকে চেয়ে বলল রবিন। দেখি ভেতরে ঢুকে, কত বড় সুড়ঙ্গ?
যাও, কিশোর বলল। তবে কাছাকাছি থেকো, ডাকলে যাতে শুনতে পাও। আমি আর মুসা আশপাশটা ভালমত দেখে আসছি।
দাড়টা বল্লমের মত বাগিয়ে ধরে ভেতরে ঢুকে গেল রবিন।
হঠাৎ এত সাহসী হয়ে উঠল কিভাবে? মুসা বলল।
ওই যে, হেসে বলল কিশোর, মানুষের তৈরি চাকা দেখলাম। তাতেই অনেকখানি দূর হয়ে গেছে ড্রাগনের ভয়।