তারচেয়ে চল রকি বীচের দিকে হাঁটতে থাকি, প্রস্তাব দিল মুসা।
এখানে যে কাণ্ডকারখানা, তাতে বিশ মাইল হাঁটাও কিছু না। কষ্ট হয়তো হবে, কিন্তু নিরাপদ জায়গায় তো গিয়ে পৌঁছব।
নিচের ঠোঁটে টান দিয়ে ছেড়ে দিল কিশোর। ঘড়ি দেখল। সময় আছে এখনও। নিচে গিয়ে গুহাটা একবার দেখলে কেমন হয়? কি বলো?
একটা পাহাড়ের চূড়ার দিকে তাকাল মুসা, ওই ড্রাগনের গুহায়? আমি বলি কি, কিশোর, এই একটা রহস্য তুমি ভুলে যাও। বাদ দাও কেসটা।
রবিনের দিকে ফিরল কিশোর, তোমার কি বক্তব্য?
মুসার সঙ্গে আমি একমত। মারটিন কি বললেন, মনে নেই? খুব বিপজ্জনক জায়গা। ড্রাগনের কথা না হয় বাদই দিলাম, ভূমিধসও কম খারাপ না। মেরে ফেলার জন্যে যথেষ্ট।
পাড়ের কাছে এসে দাঁড়াল কিশোর। উঁকি দিয়ে নিচে তাকাল একবার! পুরানো কাঠের সিঁড়ির রেলিঙে হাত রেখে বলল, না দেখে ফিরে যাওয়াটা কি ঠিক হবে? দেখে গেলে, বাড়ি গিয়ে ভাবনাচিন্তা করার একটা বিষয় পাব। না দেখে গেলে কি বুঝব?
কাঠের সিঁড়ি বেয়ে নামতে শুরু করল সে।
রবিনের দিকে তাকাল মুসা। নিচু স্বরে কিশোর যাতে শুনতে না পায় এমন করে বলল, আমাদের মতামতের কোন দামই দিল না। তার কথা কেন শুনতে যাব?
ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল রবিন। জানোই তো, ও গোঁয়ার। যা বলে, করে ছাড়ে। ধরে নাও না, আমরা ওর চেয়ে অনেক বেশি ভদ্রলোক, হাসল সে।
মুসাও হাসল। হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। আমরা ভদ্রলোকই। চলো। এখানে দাঁড়িয়ে থাকা মোটেও নিরাপদ নয়। কে জানে, মারটিন না আবার কোন উড়ুক্কু ঝামেলা ছুঁড়ে মারে। হেরিঙকেও বিশ্বাস নেই। মানুষের ওপর টার্গেট প্র্যাকটিসের শখ চাপলে মরেছি।
রেলিঙ ধরে নামতে শুরু করল রবিন।
তারপর মুসা।
খুবই পুরানো সিঁড়ি, সরু ধাপগুলো বেশি কাছাকাছি, নড়বড়ে। কাঁচম্যাচ করে উঠছে। খাড়াও যথেষ্ট।
ভয়ে ভয়ে নামছে দু-জনে। নিচের দিকে তাকাচ্ছে না।
ওপরে তাকাল কিশোর। দুই সহকারী নামতে দেখে মুচকি হাসল। কিন্তু হাসি মুছে গেল শিগগিরই। পনেরো ফুট ওপরে রয়েছে তখনও, এই সময় ঘটল অঘটন।
কোন রকম জানান না দিয়ে মুসার ভারে ভেঙে গেল একটা তক্তা। পিছলে গেল পা। রেলিঙ চেপে ধরে পতন রোধ করার অনেক চেষ্টা করল সে, পারল না। জোরাজুরিতে রেলিঙের জোড়াও গেল ছুটে। নিচে পড়তে শুরু করল সে।
মুসার চিৎকারে চমকে ওপরে তাকাল রবিন। তাড়াতাড়ি নামার চেষ্টা করল। কিন্তু কয় ধাপ আর নামবে? তার গায়ের ওপর এসে পড়ল মুসা।
রবিনের হাতও ছুটে গেল। সে-ও পড়তে লাগল।
ময়দার বস্তার মত এসে কিশোরকে আঘাত করল যেন দুটো শরীর। ঠেকানোর প্রশ্নই ওঠে না। রেলিঙ ভাঙল, পায়ের নিচের তক্তা ভাঙল, ভেঙে সবসুদ্ধ নিচে পড়তে শুরু করল কিশোরের শরীর।
ধুপ ধুপ করে নিচে পড়ল তিনটে দেহ।
কিশোরের ওপর কে পড়ল দেখার সময় পেল না সে, তার আগেই মাথা ঠুকে গেল পাথরে।
আঁধার হয়ে গেল সবকিছু।
ছয়
কিশোর, তুমি ঠিক আছ?
মিটমিট করে চোখ মেলল কিশোর। মুসা আর রবিনের চেহারা। আবছা দেখতে পেল, কেমন যেন হিজিবিজি দেখাচ্ছে দুটো মুখই, চেয়ে রয়েছে তার দিকে।
চোখ বন্ধ করে মাথা ঝাড়া দিয়ে আবার মেলল সে। উঠে বসল। চোখের পাতায় লেগে থাকা বালি সরাল, মুখের বালি পরিষ্কার করল, তারপর বলল, হ্যাঁ, ঠিকই আছি। আমার ওপর কে পড়েছিল?
নাকমুখ ভোতা করে ফেলেছ। বালিতে দেবে গিয়েছিল তাই রক্ষা।
ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল কিশোর। আশপাশে ভাঙা তক্তা পড়ে আছে, তার একটা তুলে নিয়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখল। না, এটাতে নেই। ফেলে দিয়ে আরেকটা তুলল। চতুর্থ তক্তাটা এক নজর দেখেই মাথা ঝাঁকাল সে। মুসা, তোমার দোষ নয়। তোমার ভারে ভেঙেছে বটে, তবে কারসাজি করে না রাখলে ভাঙত না। এমনভাবে করে রেখেছে, যাতে পায়ের চাপে ভেঙে যায়।
দুই সহকারীর দিকে কাঠটা বাড়িয়ে দিল সে। ভাল করে দেখলেই বুঝতে পারবে। নিচের দিকে কেটেছে, যাতে দেখা না যায়।
হাতে নিয়ে রবিন আর মুসাও দেখল।
রবিন বলল, ঠিক বোঝা যায় না। ধরলাম, তোমার কথাই ঠিক। কিন্তু আমরা নামব, এটা কে জানে?
ঠিক, রবিনের কথায় সায় দিয়ে বলল মুসা। কিশোর, এটা তোমার অনুমান। দেখে তো বোঝা যায় না, কাটা হয়েছে। আমরা যে আসব, কে কে জানে, বলো? নিশ্চয় মিস্টার জোনস, মারটিন কিংবা হেরিঙ কাটেননি?
মাথার যেখানটায় বাড়ি খেয়েছে কিশোর, ফুলে উঠেছে সুপারির মত। সেখানে হাত বোলাচ্ছে, দৃষ্টি দূরের আরেক সিঁড়ির দিকে। কি জানি, কণ্ঠে অনিশ্চয়তা। ভুলও হতে পারে আমার। তবে করাতে কাটা বলেই মনে হলো।
পরস্পরের দিকে তাকাল মুসা আর রবিন। সাধারণত কোন ব্যাপারে ভুল করে না কিশোর পাশা, ভুল যে করেনি জোরগলায় বলেও সেটা; সে জন্যেই এত সহজে ভুল স্বীকার করাটা বিস্মিত করেছে দু জনকে।
ঠোঁট কামড়াল কিশোর। যা হবার তো হয়েছে, চলো, যাই।
কোথায়? জানতে চাইল মুসা। ওই সিঁড়িটা দিয়ে উঠে চলে যাব? দূরের সিঁড়িটা দেখাল সে।
না। অঘটন যা ঘটার তো ঘটেই গেছে। এখন আর ফিরে যাব কেন? যে কাজে এসেছি, সে কাজ সারব। সৈকতে, গুহায় ড্রাগনটার চিহ্ন খুঁজব।
মনে মনে খুশি হলো কিশোর, তবে সেটা প্রকাশ করল না।
সাগরের দিকে হাঁটতে শুরু করল। বলল, পানির ধার থেকে শুরু করব। কারণ, সাগর থেকে উঠে ড্রাগনটাকে গুহায় ঢুকতে দেখা গেছে।