উঠে গিয়ে এ লেখা ড্রয়ারটা খুলে এক টুকরো কাগজ বের করল হ্যামার। একটা পেপার কাটিং। দৈনিক লস অ্যাঞ্জেলেস। এক খুঁতখুঁতে রিপোর্টার সন্দেহ করে বসেছিল, মিস্টার ওয়েসটনকে রহস্যময় লোক মনে হয়েছিল তার। খোঁজখবর শুরু করল। একদিন আমার কাছে এসে হাজির, তখন হোরাশিও মারা গেছেন, তার আসল নাম গোপন করার আর কোন মানে দেখলাম না। বলে দিয়েছি রিপোর্টারকে। হোরাশিওর অতীত জীবন সম্পর্কে সামান্য যা জানি, তা-ও বলেছি। কাগজে বেরিয়েছে, যে কেউ জেনে যেতে পারে তার আসল নাম।
কাগজের টুকরোটা কিশোরের হাতে দিল উকিল।
অন্য তিনজন ঘিরে এল কিশোরকে, কাগজের লেখা দেখতে।
ছোট অক্ষরে আকর্ষণীয় হেডলাইন: ডায়াল ক্যানিয়নের নির্জন বাড়িতে রহস্যময় লোকটির মৃত্যু!
দ্রুত লেখাটা পড়ে ফেলল কিশোর। জানা গেল, বিশ বছর আগে হেনরি ওয়েসটন ছদ্মনাম নিয়ে হলিউডে এসেছিলেন হোরাশিও অগাস্ট। তার আগে অনেক বছর কাটিয়েছেন পশ্চিম ভারতীয় দ্বীপপুঞ্জগুলোতে। ওখানে থাকতেই প্রচুর টাকা কামিয়েছেন। তরুণ বয়েস তখন, দক্ষিণ সাগর থেকে শুরু করে মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন জায়গায় পাড়ি জমিয়েছেন, বোধহয় ব্যবসার খাতিরেই।
হলিউডের উত্তরে নির্জন পাহাড়ি এলাকায় জায়গা কিনে মস্ত বাড়ি বানিয়েছিলেন হােরাশিও অগাস্ট। লােকালয় থেকে দূরে থেকেছেন যেন ইচ্ছে করেই। এত বড় বাড়ি দেখাশােনার জন্যে তােক রেখেছিলেন মাত্র দুজন। কোন বন্ধুবান্ধব ছিল না তার। পুরানাে ঘড়ি আর বই সংগ্রহের বিচিত্র নেশা ছিল তার, বিশেষ করে ল্যাটিন ভাষায় লেখা বই। স্যর। আর্থার কোনান ডয়েলের ওপর ছিল তার অগাধ ভক্তিশ্রদ্ধা, ডয়েলের লেখা সমস্ত বইয়ের যতগুলাে সংস্করণ পেয়েছেন, সবগুলাের কপি জোগাড় করেছেন তিনি। ছেলেবেলায় ইংল্যাণ্ডে থাকতে একবার বিখ্যাত ওই লেখকের সঙ্গে সাক্ষাৎ হয়েছিল হােরাশিওর, তারপর থেকেই তার অন্ধভক্ত হয়ে গিয়েছিলেন, ভক্ত হয়েছিলেন কোনান ডয়েলের অসামান্য সৃষ্টি গােয়েন্দা শার্লক হােমসের। |
যতদূর জানা যায়, শান্তিতেই ডায়াল ক্যানিয়নের বাড়িতে বিশ বছর কাটিয়েছেন হােরাশিও অগাস্ট নামের রহস্যময় লােকটি! অসুস্থ হয়ে মারা গেছেন, কিন্তু কিছুতেই হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া যায়নি তাকে। নিজের বাড়িতে নিজের বিছানায় শুয়ে মরার প্রবল আকাঙ্ক্ষা ছিল তার, সেজন্যেই হাসপাতালে যেতে চাননি। যা-ই হােক, শেষ ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। মানুষটির।
লম্বা, সুদর্শন এক সুপুরুষ ছিলেন হােরাশিও অগাস্ট, মাথায় ঝাঁকড়া চুল। একটাও ছবি নেই তাঁর। বাড়ি থেকে যেমন বেরােতে চাইতেন না, ছবি তােলার ব্যাপারেও ছিল তার প্রবল বিতৃষ্ণা। তার একমাত্র আত্মীয় থাকে ইংল্যাণ্ডে। ডাক্তার ডেথ সার্টিফিকেটে লিখেছেন: হােরাশিও অগাস্টের শরীরে অজস্র কাটা দাগ। তরুণ বয়েসের অনেক দুঃসাহসিক অভিযানের চিহ্ন বােধহয় ওই ছুরিতে কাটা দাগগুলাে।
হােরাশিও অগাস্টের রহস্যময় অতীত রহস্যেই ঢাকা পড়ে আছে, বিশেষ কিছুই জানা যায়নি।
আরিব্বাপ! ফোসস্ করে শ্বাস ফেলল মুসা। সত্যিই রহস্যময় লােক!
ছুরির দাগ! বিড়বিড় করল অগাস্ট। অভিযানপ্রিয়! চোরাচালানী ছিলেন না তাে?
কারও ভয়ে যে লুকিয়ে ছিলেন, রবিন বলল, তাতে কোন সন্দেহ নেই। প্রথমে ওয়েস্ট ইনডিজে গিয়ে লুকিয়েছিলেন, ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে সেখান থেকে পালিয়ে এসে লুকিয়েছেন ডায়াল ক্যানিয়নে। লস অ্যাঞ্জেলেস আর হলিউডের হাজার রকম লােকের ভিড়ে সহজেই গা ঢাকা দিয়ে থাকতে পারবেন, আশা করেছিলেন হয়তাে।
বােধহয় পেরেছেনও, রবিনের কথার পিঠে বলল কিশাের, নিজের বিছানায় শান্তিতেই চোখ বুজতে পেরেছেন। কিন্তু কেন এই ঘরকুনাে মন? কার ভয়ে? বাদামী চামড়া, কপালে তিন ফোটাওয়ালা লােকটাই বা
কে?
দাঁড়াও, দাঁড়াও! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল অগাস্ট। মনে পড়েছে! দশ বছর আগে, সেই ধোয়াটে শৈশবে… নাকমুখ কুঁচকে মনে করার চেষ্টা চালাল সে। এক রাতে, সবে বিছানায় গিয়ে শুয়েছি। হঠাৎ নিচে কথা শুনলাম, কার সঙ্গে জানি উত্তেজিত হয়ে কথা বলছে বাবা। বলল, কতবার বলব, চাচা কোথায় আছে জানি না! অনেক আগেই শুনেছি মারা গেছে! কোটি টাকা দিলেও সে কোথায় আছে বলতে পারব না!
বিছানা থেকে নেমে পা টিপে টিপে সিঁড়ির মাথায় গিয়ে দাঁড়ালাম। বসার ঘরের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে বাবা, আর
অচেনা একটা লোক। নিচু গলায় কিছু বলল লোকটা, শুনতে পেলাম না। জবাবে জোরে জোরে বলল বাবাঃ তোমার কাছে কোন্টা কত জরুরি ওসব জানার দরকার নেই আমার! রক্তচক্ষুর নাম জীবনেও শুনিনি! চাচাও কখনও লেখেনি ওটার কথা। এখন বেরোও, আমি ঘুমাব।
মাথা নুইয়ে বাবাকে বাউ করল লম্বা লোকটা, তারপর হ্যাট তুলে নেয়ার জন্যে ঘুরল। এই সময় ওপরে তাকাতেই আমার দিকে চোখ পড়ল তার, কিন্তু আমাকে দেখেও যেন দেখল না। হ্যাটটা তুলে নিয়ে আরেকবার বাবাকে বাউ করে বেরিয়ে গেল। বাবা কখনও ওর কথা আমাকে বলেনি। আমিও জিজ্ঞেস করিনি, লুকিয়ে লুকিয়ে অন্যের কথা শোনা বাবা একদম পছন্দ করে না।
জানো, কণ্ঠস্বর খাদে নামাল অগাস্ট, ওই লোকটার রঙ ছিল বাদামী, কপালে তিনটে ফোঁটা। তখন বুঝিনি, কিন্তু এখন বুঝতে পারছি উলকি দিয়ে আঁকা হয়েছিল।