কয়েক মিনিট পর বাইরে বেরোনোর দরজা খোলা এবং বন্ধ হওয়ার আওয়াজ শুনল উকিল, বুঝল, তার আক্রমণকারী বেরিয়ে যাচ্ছে। আবার আলমারির দরজায় ধাক্কাধাক্কি শুরু করল সে, খোলার চেষ্টা করল। শেষে হাল ছেড়ে দিল।
কী আর করব, মেঝেতেই বসে পড়লাম! বলল হ্যামার। জানি, আলমারির ভেতর যে বাতাস রয়েছে, তাতে আরও কয়েক ঘণ্টা টিকব। কপাল ভাল হলে কেউ না কেউ এসে পড়তে পারে। ঈশ্বরের দয়া, তোমরা এলে।
কটার সময় এটা ঘটেছিল! কিশোর জিজ্ঞেস করল।
শিওর না, জবাব দিল উকিল। এই ধরো, হাতঘড়ির দিকে তাকাল সে। নয়টা সতেরো বেজে বন্ধ হয়ে আছে কাটা, তার মানে দেড় ঘণ্টার ওপরে।
আমার ঘড়ি! চেঁচিয়ে উঠল সে। ব্যাটা যখন ধাক্কা দিয়ে ফেলল আমাকে, নিশ্চয় চোট লেগেছে! গেছে নষ্ট হয়ে।
তার মানে, শান্ত কণ্ঠে বলল কিশোর, যে-ই এই কাজ করেছে, দুঘণ্টা সময় পেয়েছে হাতে পালানোর। কোথায় আছে এখন, কে জানে! কিছু লক্ষ করেছেন? এমন কিছু, যা লোকটাকে ধরিয়ে দিতে পারে!
না। এতই চমকে গিয়েছিলাম, কিছুই খেয়াল করতে পারিনি। তা ছাড়া সময়ও দেয়নি সে আমাকে। পুরু গোঁফ, আর ভারি চশমা! ও, হ্যাঁ, চশমার কাঁচের ওপাশে তার চোখ যেন জ্বলছিল!
না, এতে চলবে না, মুসার কণ্ঠে নিরাশা।
না, চলবে না, কিশোরও একমত হলো। আচ্ছা, এ ঘরে এমন কিছু দেখছেন, যেটা অস্বাভাবিক ঠেকছে?
পুরো অফিস-ঘরে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি বোলাল উকিল। না, তেমন কিছুই তো না। মনে হচ্ছে, আমাকে আলমারিতে ভরেই সোজা ফাইল কেবিনেটের দিকে গেছে, কেবিনেট খুলে ফাইল বের করেছে, যা দরকার নিয়ে চলে গেছে। ব্যস।
হুমম! বিড়বিড় করল কিশোর, আপনমনেই বলল, তার মানে, কী খুঁজছে, জানা ছিল তার। জানা ছিল, ঠিক কোথায় ওটা পাওয়া যাবে! কয়েকটা কেবিনেটের এতগুলো ড্রয়ারের মধ্যে ঠিক ড্রয়ারটাই খুলল, ঠিক ফাইলটা বের করে আনল! অসংখ্য ফাইল, এত সহজে কী করে তা সম্ভব। তা ছাড়া মেসেজটা ফাইলে আছে, তা-ই বা জানল কী করে সে?
চোখ পিটপিট করল আবার উকিল। ইয়ে…মানে…কী জানি!
মিস্টার হোরাশিও মেসেজটা লেখার সময় আর কেউ কাছে ছিল? জানতে চাইল কিশোর।
হ্যাঁ, মাথা নোয়াল হ্যামার, ওঁর দুজন চাকর-চাকরানী। ওরা স্বামী-স্ত্রী। বুড়ো-বুড়ি। মিস্টার অগাস্টের চাকরি করেছে অনেক বছর। বাড়িঘর দেখাশোনা, বাগান পরিষ্কার, বাজার, রান্নাবাড়ী, প্রায় সব কাজই করেছে। বুড়োটার নাম হ্যারি, হ্যারিসন। মনিবের মৃত্যুর পর স্যান ফ্রানসিসকোতে চলে গেছে ওরা। মেসেজটার কথা হয়তো শুনেছে ওরা, তারপর যেই মনিব মরেছে, তার নাতিকে ফাঁকি দিতে উঠেপড়ে লেগেছে।
কিংবা কথায় কথায় অন্য কাউকে বলেছে ওরা, মুসা সন্দেহ। করল। হয়তো সেই তৃতীয়জন অনুমান করেছে, মিস্টার হ্যামারের কাছে। মেসেজের কপি আছে! নিতে এসেছে।
তা-ও হতে পারে, উকিল বলল। ওরা হয়তো ভেবেছে, মিস্টার হোরাশিও গুপ্তধন লুকিয়ে রেখেছেন। সাঙ্কেতিক চিঠিতে মূল্যবান কিছুর কথা লেখা থাকলেই লোকে ধরে নেয়, গুপ্তধন, কিংবা চোরাই টাকা। সেগুলো খুঁজে পাওয়ার জন্যে পাগল হয়ে ওঠে। সত্যি কথা কী, মিস্টার হোরাশিও খুব গরীব অবস্থায় মারা গেছেন। তার বাড়িটা পর্যন্ত বাধা ছিল। অন্যের কাছে, সেই লোকটা এখন বাড়ি দখল করে নিয়েছে। বাড়ির। জিনিসপত্র বিক্রি করে দোকানের বকেয়া বিল দিয়েছি, অনেক টাকা বাকি ফেলে গিয়েছিলেন হোরাশিও।
কিন্তু মেসেজ বলছে, মূল্যবান কিছু আমার জন্যে রেখে গেছে। দাদা, অগাস্ট প্রতিবাদ করল। এমন কিছু, কোন কারণে সেটাকে ভয় পেত সে।
হ্যাঁ, তা ঠিক, চশমা খুলে কাঁচ পরিষ্কার শুরু করল উকিল। কী। জিনিস, আমিও জানি না, আমাকেও বলেনি। কথায় কথায় অনেক বার। বলেছেন: রয়, আমার ব্যাপারে অনেক কিছুই জানো না তুমি, জানার চেষ্টাও কোরো না, আমি গোপনই রাখতে চাই। আমার নামেও গোলমাল আছে। আর হ্যাঁ, বাদামী চামড়া, কপালে উলকি দিয়ে তিনটে বিন্দু আঁকা রয়েছে, এমন কোন মানুষকে যদি কাছাকাছি ঘুরঘুর করতে দেখো, বুঝবে। তুমুল ঝড় আসছে!
আজব লোক ছিলেন মিস্টার ওয়েসটন…ইয়ে, মিস্টার হোরাশিও। অদ্ভুত, কিন্তু ভাল মানুষ। তার গোপন ব্যাপার নিয়ে আমি কখনও মাথা ঘামাইনি, বলার জন্যে তাকে চাপাচাপি করিনি।
মিস্টার হোরাশিওর আরেক নাম ওয়েসটন ছিল? কিশোর প্রশ্ন করল।
হ্যাঁ, হেনরি ওয়েসটন নামেই হলিউডে পরিচিত ছিলেন। আমিও ওই নামই জানতাম। মৃত্যুর আগে আমাকে ডেকে আসল নাম বললেন, নাতির নাম-ঠিকানা জানালেন, নইলে চিঠি পাঠাতে পারতাম না।
কেবিনের দিকে নজর ঘুরে গেল কিশোরের, সেই ড্রয়ারটার দিকে তাকাল, যেটাতে মিস্টার হোরাশিও অগাস্টের ফাইল রেখেছে উকিল।
মিস্টার হ্যামার, ড্রয়ারটার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল কিশোর, ভুল ড্রয়ারে রাখেননি তো ফাইলটা? অগাস্টের আদ্যক্ষর এ, কিন্তু ওয়েসটনের বেলায়? নাকি ফাইলে নাম বদলে অগাস্টই লিখেছেন?
হ্যাঁ, নিশ্চয়। এসব ব্যাপারে সাবধান থাকি আমি, কাগজপত্র নিখুঁত রাখার চেষ্টা করি।
কিন্তু ওই লোকটা জানল কী করে? কেন সে ওয়েসটন খুঁজতে ডব্লিউ লেখা ড্রয়ার খুলল না?
কী জানি, ছাতের দিকে তাকাল উকিল। হয়তো, হয়তো হ্যারিসনরা কোনভাবে আসল নাম জেনে ফেলেছিল…ও, হ্যাঁ। একটা জিনিস দেখাচ্ছি তোমাদের।