রয় হ্যামার
অ্যাটর্নি-অ্যাট-ল।
বেল বাজিয়ে ঢুকে পড়ন। বোতাম টিপল কিশোর। বেলের শব্দ শোনা গেল। নির্দেশ দেয়া আছে, কাজেই দরজা খুলে ঢুকে পড়ল সে, তার পেছনে অন্য তিনজন।
বসার ঘরটাকে অফিস বানিয়েছে হ্যামার। বড় একটা টেবিল, অনেকগুলো বুকশেলফে মোটা মোটা আইনের বই, আর কয়েকটা ফাইল কেবিনেট, তাতে ফাইল। একটা কেবিনেট খোলা, টেবিলে অগোছালোভাবে পড়ে রয়েছে একটা ফাইল, কাগজপত্র এলোমেলো। টেবিলের পাশে উল্টে পড়ে আছে একটা চেয়ার। উকিল নেই ঘরে।
কিছু একটা ঘটেছে, চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। গোলমাল! গলা। চড়িয়ে ডাকল, মিস্টার হ্যামার! মিস্টার হ্যামার! কোথায় আপনি?
সাড়া নেই। রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে ছেলেরা।
আবার ডাকল কিশোর।
এইবার সাড়া মিলল। অনেক দূর থেকে যেন ভেসে এল চাপা জবাব, ভাল করে কান না পাতলে শোনাই যেত না।
বাঁচাও! বাঁচাও! আমার দম বন্ধ হয়ে যাচ্ছে!
চার
আমাকে বাঁচাও! আবার শোনা গেল চাপা কণ্ঠ। আমি মরে যাচ্ছি!
ওই যে! উল্টো দিকের একটা দেয়াল আলমারির দরজা খোল মুসা, দুটো বুকশেলফের মাঝখানে দরজাটা। স্পিঙ লক লাগানো, পাল্লা ভেজিয়ে দিলে আপনাআপনি লেগে যায় এই তালা, ভেতর থেকে খোলা যায় না। নব ধরে মোচড় দিল মুসা, টান দিতেই হা হয়ে খুলে গেল পাল্লা।
আলমারির মেঝেতে বসে রয়েছে ছোট্ট একজন মানুষ, হাঁ করে জোরে জোরে দম নিচ্ছে। সোনালি ফ্রেমের চশমায় সুতো বাধা, এক কান থেকে ঝুলছে চশমাটা। টাইয়ের নট ঢিলে, ঘাড়ের ওপর উঠে গেছে, বাঁকা হয়ে আছে টাই। সাদা চুল এলোমেলো।
আহ, বাঁচালে আমাকে! ফিসফিস করে বলল লোকটা। ধন্যবাদ! ধরো, তোলো আমাকে, প্লিজ!
আলমারির অপরিসর জায়গা থেকে লোকটাকে বের করে আনল। মুসা আর রবিন, দাঁড়াতে সাহায্য করল।
উল্টে থাকা সুইভেল চেয়ারটা তুলে জায়গামত রাখল কিশোর। চেয়ারটা সোজা করেই ক্ষণিকের জন্যে স্থির হয়ে গেল, বিস্ময় ফুটল চেহারায়।
আশ্চর্য! আপনমনেই বিড়বিড় করল সে।
ধরে ধরে এনে লোকটাকে চেয়ারে বসিয়ে দিল ছেলেরা। গভীরভাবে কয়েকবার শ্বাস টানল সে। কাঁপা হাতে টাই ঠিক করল, চশমা বসাল নাকে।
ঠিক সময়ে এসে পড়েছ! গলা কাঁপছে এখনও তার। আরেকটু দেরি করলেই…! শিউরে উঠল সে।
আপনি নিশ্চয় মিস্টার রয় হ্যামার, বলল রবিন। এক এক করে চার কিশোরের ওপরই নজর বোলাল লোকটা। মাথা কেঁকাল। হ্যাঁ। চোখ পিটপিট করল। কিন্তু তোমরা?
আমি অগাস্ট অগাস্ট, স্যর, এগিয়ে এসে পরিচয় দিল ইংরেজ কিশোর। আজ আপনার সঙ্গে দেখা করার ডেট দিয়েছেন।
ও, হ্যাঁ, আবার মাথা ঝোকাল উকিল। এরা তোমার বন্ধু, না?
এতে আমাদের পরিচয় পাবেন, স্যর, তিন গোয়েন্দার একটা কার্ড বাড়িয়ে ধরল কিশোর।
গোয়েন্দা! কার্ডটা পড়ে অবাক হয়েছে হ্যামার।
আমাকে সাহায্য করতে রাজি হয়েছে ওরা, অগাস্ট বলল।
তাই? আবার চোখ পিটপিট করল উকিল। আরেকবার তাকাল কার্ডটার দিকে। সুন্দর! খুব সুন্দর!
চুপ করে রইল গোয়েন্দারা। অগাস্টও।
তা হলে তোমরা গোয়েন্দা! বিড়বিড় করল উকিল। খুব ভাল, খুব ভাল। যার যা হওয়ার ইচ্ছে, ছোটবেলা থেকে সে-পথে যাওয়াই ভাল। …হায় হায়! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল সে। আসল কথাই ভুলে গেছি! ব্যাটারা, ব্যাটারা আমাকে আটকে রেখেছিল!
লাফিয়ে উঠে দাঁড়াল উকিল। চারপাশে চোখ বোলাতে গিয়ে খোলা কেবিনেটটার ওপর দৃষ্টি আটকাল। হায় হায়! আমার ফাইল, গোপন কাগজপত্র! হারামজাদা আমার ফাইল ঘেঁটেছে। কী জানি নিল! আর এটা এখানে কেন! টেবিলের ফাইলটার দিকে আঙুল তুলল সে। আমি তো রাখিনি!
ফাইলের ওপর এসে হুমড়ি খেয়ে পড়ল উকিল, দ্রুত পাতা উল্টে চলল; দেখছে, কোন্ কাগজটা নেই।
তোমার দাদার ফাইল এটা, অগাস্টকে বলল হ্যামার। বিশ বছর ধরে ওঁর উকিল ছিলাম। ওঁর সম্পর্কে যত কাগজপত্র, সব এই ফাইলে রেখেছি। এটার প্রতি আগ্রহ হবে কেন! …মেসেজ, চেঁচিয়ে উঠল উকিল, মেসেজটা নিয়ে গেছে!
অগাস্টের দিকে তাকাল হ্যামার। তোমাকে যে চিঠিটা পাঠিয়েছি, তার নকল! নিয়ে গেছে! …লেখাটা আগাগোড়াই অবশ্য অর্থহীন মনে হয়েছে আমার কাছে। তবু একটা কপি করে রেখেছিলাম। কেবিনেটে রেখেছি ফাইল, এর চেয়ে সাবধান আর হয় মী করে লোকে! কিন্তু দেখলে তো, গেল চুরি হয়ে!
কী হয়েছিল, স্যর, খুলে, বলবেন? এতক্ষণে আবার কথা বলল কিশোর। ব্যাপারটা খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হচ্ছে!
কাগজগুলো গুছিয়ে ঠিকঠাক করে ফাইলটা আবার কেবিনেটে রাখল উকিল। ড্রয়ার ঠেলে লাগিয়ে তালা আটকে দিল। তারপর বসল আবার চেয়ারে।
রয় হ্যামারের বক্তব্য: ডেস্কে বসে কাজ করছিল সে, এই সময় কোনরকম সাড়া না দিয়ে দরজা খুলে একটা লোক এসে ঘরে ঢুকল। মাঝারি উচ্চতা, কালো পুরু গোঁফ, চোখে ভারি পাওয়ারের চশমা। উকিল মুখ খোলার আগেই দুই লাফে কাছে চলে এল আগন্তুক, থাবা দিয়ে হ্যামারের নাকের ওপর থেকে চশমা ফেলে দিল, ধাক্কা দিয়ে তাকে চেয়ারসহ উল্টে ফেলল মেঝেতে, তারপর টেনে নিয়ে গিয়ে ভরল আলমারিতে। বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দিল, আপনাআপনি লেগে গেল অটোমেটিক তালা।
প্রথমে, দরজায় ধাক্কাধাক্কি করে হ্যামার, চেঁচামেচি করে, সাহায্য চায়। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরেই বুঝতে পারল, শক্তি আর আলমারির ভেতরের অক্সিজেন ক্ষয় করছে বৃথাই। বাড়িতে কোন চাকর-বাকর কিংবা আর কেউ নেই যে তার চিৎকার শুনবে। তাই চুপ করে গেল।