গোয়েন্দাপ্রধানের ছড়ানো হাতের তালুতে জ্বলছে উজ্জ্বল লাল চুনি!
আসল রক্তচক্ষু, হাসল কিশোর। ছুঁড়ে ফেলেছি নকলটা, তিন ফোঁটা যেটা ফেলে গিয়েছিল, মনে আছে? কেন জানি মনে হলো তখন, নিয়ে নিলাম সঙ্গে। এখন তো দেখছ, কাজেই লেগেছে। গর্তে আসলটাই ফেলেছিলাম। এক ফাঁকে ওটা তুলে পকেটে ঢুকিয়ে নকলটা বের করেছি। হাহ হাহ! কলা দেখিয়ে এসেছি ব্যাটাদের!
কিশোর, সত্যিই তুমি একটা জিনিয়াস! উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করল রবিন।
আর অভিনয়টা কী করল দেখলে! অগাস্ট বলল। আমি তো ভেবেছিলাম, হার্টফেল করছে! ডাকাতগুলোকে পর্যন্ত বোকা বানিয়ে দিল!
নাহ্, আমিও মেনে নিচ্ছি, হাত তুলল মুসা, ঝকঝকে সাদা দাঁত বেরিয়ে পড়েছে। আমাদের কিশোর পাশার কাছে শার্লক হোমস কিংবা এরকুল পোয়ারো কিছু না!
আমিও তাই বলি, অন্ধকার থেকে ভেসে এল শীতল, শান্ত একটা কণ্ঠ। কিন্তু আর কোন চালাকি নয়, খোকা।
ছেলেদের হতভম্ব ভাব কাটার আগেই দপ করে জ্বলে উঠল অফিসের বাইরে লাগানো আলো। লম্বা, পাতলা লোকটা নেমে এল দরজার কাছ থেকে। ডান হাত বাড়ানো, পাথরটা নেয়ার জন্যে। অন্য হাতে মারাত্মক ছড়িটা। তিন-ফোঁটা!
বোকা হয়ে গেছে ছেলেরা। কথা ফুটল না মুখে।
পালানোর চেষ্টা কোরো না, কড়া গলায় বলল তিন-ফোঁটা। হাতের ছড়িটা ঠেলে দিল ছেলেদের দিকে, ঝট করে বেরিয়ে এল তীক্ষ্ণধার ছুরির ফলা। ঝকঝক করছে।
সেই কখন থেকে বসে আছি, বলল সে। চমৎকার বুদ্ধি করেছিলে, রোলস রয়েসে করে ডামি পাঠানো! কিন্তু কাজ হলো না। কিছুই। তোমাদের চালাকি ওরাও ধরে ফেলেছে, আমিও। কেন যেন মনে হচ্ছিল, গোঁফওয়ালা রামছাগলগুলোকে ধোকা দেবেই তোমরা। তাই এখানে বসে আছি। ঠিকই করেছি। দাও।
আর কিছু করার নেই, ভাবল রবিন, রক্তচক্ষু হাতছাড়া করতেই হচ্ছে।
এখনও দ্বিধা করছে কিশোর। হাতের তালুতে যেন ওজন পরীক্ষা করল পাথরটা, ঢোক গিলল। মুখ তুলে তাকাল লোকটার দিকে। মিস্টার রামানাথ, আপনি কি কাটিরঙ্গা মন্দিরের কেউ? ন্যায়-বিচারের মন্দিরের?
নিশ্চয়ই, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিল রামানাথ। নইলে পৃথিবীর এ মাথায় আসি? আমি মন্দিরের পুরোহিত। পঞ্চাশ বছর হলো, মন্দির থেকে চুরি গেছে রক্তচুক্ষু, মন্দিরের একজন টাকা খেয়ে হোরাশিও অগাস্টকে দিয়ে দিয়েছিল ওটা। তখন থেকেই খোঁজা হচ্ছে ওই পুণ্য-পাথর। চুনিটার উদ্দেশে মাথা নোয়াল সে। আমার অনেক ভাগ্য, অনেক পুণ্যের ফলেই আজ খুঁজে পেয়েছি এটা। ভগবান দয়া করেছেন। এক কদম বাড়াল। দাও।
কিশোরের পেট ছুঁই ছুঁই করছে ছুরির ফলা, কিন্তু সে অবিচল। বলল, পাথরটার ক্ষতি করার ক্ষমতা দূর হয়েছে পঞ্চাশ বছরে; ঠিক, কিন্তু পুরোপুরি কি হয়েছে? আপনি চুরি করে কিংবা ছিনিয়ে নিলে ক্ষতি হবে না?
বিদ্যুৎ খেলে গেল যেন রামানাথের শরীরে। এক লাফে পিছিয়ে গেল। সে। সট করে ছুরির ফলা ঢুকে গেল ছড়ির খাপে।
গাস, এই নাও, পাথরটা বাড়িয়ে ধরল কিশোর। আমি এটা খুঁজে পেয়েছি, তোমাকে উপহার দিলাম। তোমার কিছু হবে না। কিন্তু যদি কেউ তোমার কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়, পাথরের ভয়ানক অভিশাপ নামবে তার ওপর।
থরথর করে কেঁপে উঠল রামানাথ। দুচোখে আতঙ্ক। সামলে নিতে সময় লাগল। ভয়ে ভয়ে বলল, আ-আমাকে ক্ষমা করো, খোকা! আমি ভুলেই গিয়েছিলাম! ছড়ি ফেলে দিয়ে দুহাত জড়ো করে প্রণাম করল রক্তচক্ষুকে। ঘাট হয়েছে, ভগবান, অধমকে ক্ষমা করো!
মুখ তুলে কিশোরের দিকে তাকাল রামানাথ। কিশোর, চলো না, অফিসে বসি? কথা আছে।
চলুন।
অফিসে এসে ঢুকল পাঁচজনেই। চেয়ার টেনে বসল। পকেট থেকে চেকবই আর কলম বের করে খসখস করে লিখল রামানাথ। ছিঁড়ে নিয়ে চেকটা ঠেলে দিল অগাস্টের দিকে। দেখো, এতে চলবে কিনা। রক্তচক্ষু তোমাদের কাছে একটা দামী পাথর, আর কিছু না, কিন্তু আমার কাছে দেবতা। যদি ওতে না হয়, আরও টাকা দেব। কিন্তু দেবতাকে নিয়ে দেশে ফিরব না।
চেকের অঙ্ক দেখে চোখ কপালে উঠল চার কিশোরের।
উঠে এসে আস্তে করে পাথরটা টেবিলে রাখল অগাস্ট, চেকটাও, রামানাথের সামনে। আপনার দেবতাকে আটকাব না আমি, মিস্টার রামানাথ, নিয়ে যান। টাকাও লাগবে না। যান, রক্তচক্ষু উপহার দিলাম আমি আপনাকে।
আরেকবার পাথরটাকে প্রণাম করে সযত্নে বুকপকেটে ঢুকিয়ে রাখল রামানাথ। দুগালে অশ্রুধারা। চেকটা আবার ঠেলে দিয়ে বলল, তোমার মত নির্লোভ ছেলে আমি দেখিনি, গাস, মাই বয়! আমাকে অপমান কোরো না, এই টাকাটা তোমাদেরকে আমি উপহার দিলাম। ভগবান আমাকে অনেক দিয়েছেন। যা দিলাম, এটা আমার কাছে কিছুই না। নাও। আমি আশীর্বাদ করছি, তোমরা অনেক বড় হবে, অনেক অনেক বড়।
চেকটা নিয়ে পকেটে রেখে দিল অগাস্ট।
আচ্ছা, মিস্টার রামানাথ, কিশোর বলল, কয়েকটা কথার জবাব দেবেন?
বলো?
কী করে জানালেন, রক্তচক্ষু আমেরিকায় আছে?
আমরা জানতাম, হোরাশিও অগাস্টই রক্তচক্ষু নিয়ে পালিয়েছে। পালাল তো পালাল, একেবারে গায়েব। কত খোঁজাখুঁজি করেছি, পাইনি। দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর পর তার নাম ছাপা হলো পত্রিকায়, তার সম্পর্কে লেখা হলো। ছুটে এলাম আমেরিকায়।
তো, কালো-ফোদের ব্যাপারটা কী? ওরা কী করে জানল রক্তচক্ষুর কথা?
আমি বলেছি। অনেক টাকা দেব চুক্তি করে আমিই ওদের কাজে লাগিয়েছি।