এক সময়ে থেমে গেল মুসা। বেলচায় ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে কপালের ঘাম মুছল। উফফ, আর পারছি না! হাঁপাচ্ছে পরিশ্রমে। কিশোর, ভুল করেছ, জায়গা এটা না।
চুপ করে ভাবছে কিশোর। বাড়ির দিকে তাকাল আরেকবার, তারপর ফিরল কালো পাহাড়ের চূড়াটার দিকে। দূরত্ব আন্দাজ করল। তারার আলোয়। বাড়িটার দিকে এক কদম এগোল। এখানে এসো। দেখা যাক খুড়ে।
নীরবে বেলচা চলল আবার কিছুক্ষণ। হঠাৎ ঠং করে কীসে যেন বাড়ি খেল বেলচা, পাথুরে কিছুতে।
কিশোর! কোথায় কী করছে ভুলে গিয়ে আবার চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
চুপ! দ্রুত একবার এদিক-ওদিক চেয়ে নিল কিশোর। নেমে পড়ল দ্বিতীয় গর্তটায়। টর্চের আলোয় দেখা গেল ছোট একটা বাক্সের কোণ বেরিয়ে আছে। ঝুঁকে আঙুল দিয়ে খুঁচিয়ে মাটি সরাল, শক্ত করে চেপে ধরে টান দিতেই উঠে এল বাক্সটা। এটাই হবে, ফিসফিস করল সে। সাজিমাটি দিয়ে তৈরি। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছে। রবিন, টর্চটা ধরো।
ছোট্ট একটা সোনার তালা লাগানো বাক্সে। মুঠো করে ধরে চাপ দিল কিশোর, খুলল না তালা। ছোট হলেও বেশ শক্ত। শেষে একটা পাথর কুড়িয়ে নিয়ে জোরে জোরে কয়েক ঘা লাগাতেই কটাং করে ভেঙে গেল আংটা। তালাটা খুলে ছিটকে পড়ল।
আস্তে করে ডালা তুলল কিশোর।
টর্চের আলোয় ঝিকিয়ে উঠল একটা লাল পাথর, তুলোর শয্যায় শুয়ে আছে।
ইয়াল্লা! আবার চেঁচাল মুসা। কিশোর, দিয়েছ সেরে কাজ!
বাহ, ভারি সুন্দর! অগাস্টও চেঁচিয়ে উঠল।
কিছু বলতে গিয়েও থেমে গেল কিশোর। পাথরের মত স্থির হয়ে গেল অন্য তিনজন।
ঝাড়া মেরে অন্ধকারকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে যেন তীব্র উজ্জ্বল আলো। শক্তিশালী কয়েকটা টর্চের আলো পড়েছে গায়ে। চোখ মেলতে। পারছে না ছেলেরা। পায়ের শব্দ কানে আসছে।
নড়বে না, গর্জে উঠল একটা পরিচিত ভারি কণ্ঠ। দাও, পাথরটা।
চোখ পিটপিট করছে ছেলেরা, আবছামত দেখতে পাচ্ছে চারটে টর্চের ওপাশে চার জোড়া গোঁফ, এগিয়ে আসছে চারজন মানুষ। একজনের হাতে পিস্তল। ভয়ঙ্কর নলের কালো মুখ ছেলেদের দিকে।
কালো-ফোর দল! চাপা কণ্ঠে বলল রবিন। ব্যাটারা ঘাপটি মেরে বসে ছিল, ট্রাকগুলোর আড়ালে।
দুপুরে এসেছিলে, শুনেছি, বলল রাইস। ভাগিয়ে নাকি দিয়েছিল। শুনেই বুঝেছি, আবার আসবে তোমরা।
আলাপ বাদ দাও তো, জ্যাকির খসখসে গলা। অধৈর্য হয়ে উঠেছে সে। পাথরটা নিয়ে সরে পড়া দরকার। এই, ছেলে, দাও ওটা। এগিয়ে এল সে।
ভীষণ ভয় পেয়েছে কিশোর, এতখানি ভয় পেতে আর তাকে দেখেনি কখনও রবিন আর মুসা। চোখ উল্টে পড়ে যাবে যেন যে-কোন সময়! কাঁপছে থরথর করে। তার কাঁপা হাত থেকে বাক্সটা উল্টে পড়ে গেল গর্তে! এই…গুলি কোরো না! ..আ-আমি তুলছি!
ঝুঁকে বসে কাঁপা কাঁপা আঙুলে ঝুরঝুরে মাটি ঘটল সে, পাথরটা দেখা গেল হাতে। উঠে দাঁড়িয়ে বলল, এই যে, নাও! তবু আমাদেরকে মেরো না!
কিন্তু কেউ এসে পাথর নেয়ার সময় পেল না। আচমকা হাত ঘুরিয়ে পাথরটা ছুঁড়ে মারল সে, উজ্জ্বল আলোয় চকিতের জন্যে একটা রঙিন ধনুক সৃষ্টি করে জ্যাকির মাথার ওপর দিয়ে উড়ে চলে গেল পাথরটা, হারিয়ে গেল পিছনের অন্ধকারে।
সতেরো
গাল দিয়ে উঠল জ্যাকি, এক ঝটকায় ঘুরে দাঁড়াল। খোজো! চেঁচিয়ে উঠল সে। আলো ঘোরাও, জলদি!
ছেলেদের দিক থেকে একসঙ্গে ঘুরে গেল সব কটা টর্চ।
দৌড় দাও! চেঁচিয়ে নিজের সঙ্গীদেরকে বলল কিশোর। জলদি! ওরা গুলি করবে না।
চারটে তাড়া খাওয়া খরগোশের মত ছুটল ছেলেরা রাস্তার দিকে, অন্ধকার লন উড়ে পেরিয়ে এল যেন। জায়গামতই বসে আছে বোরিস, ছেলেদেরকে ছুটে আসতে দেখেই যা বোঝার বুঝে নিল। স্টার্ট দিল ইঞ্জিন।
বোরিস! জলদি! পিকআপে উঠেই চেঁচিয়ে উঠল কিশোর। জলদি ছাড়ুন!
কোন প্রশ্ন করল না বোরিস।
প্রচণ্ড এক ঝাঁকুনি দিয়েই ছুটতে শুরু করল পিকআপ। পেছনে তাকিয়ে দেখল ছেলেরা, গুফোর দলকে দেখা যাচ্ছে না। পাথরটা এখনও পায়নি নিশ্চয়, ওটা খোঁজা নিয়েই ব্যস্ত।
থরথর করে কাঁপছে পিকআপের পুরানো বডি, নীরব রাতে ইঞ্জিনের গোঁ গোঁ শুনে মনে হচ্ছে যেন কোন দৈত্যের গর্জন, দুপাশের পাহাড়ে বাড়ি খেয়ে অনেক বেশি বিকট হয়ে উঠছে শব্দ। প্রচণ্ড ঝাঁকুনি, স্থির হয়ে বসে থাকাই মুশকিল। একে অন্যের গায়ে গা ঠেকিয়ে চাপাচাপি করে বসে আছে ছেলেরা।
সরু গিরিপথ পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠল পিকআপ, এইবার শান্তি।
তবুও চুপ করে রইল ছেলেরা। ইয়ার্ডে পৌঁছার আগে একটা কথাও বলল না কেউ।
ইয়ার্ডের অন্ধকার চত্বরে এনে গাড়ি রাখল বোরিস।
চুপচাপ ট্রাক থেকে নামল ছেলেরা। বেলচা, মেটাল ডিটেকটর ফেলে এসেছে; আনতে পারেনি। আর অবশ্যই, লাল পাথরটাও।
অফিসের ধারে এসে গোল হয়ে দাঁড়াল চার কিশোর।
সব শেষ! দীর্ঘশ্বাস ফেলল মুসা।
তীরে এসে তরী ডুবল! রবিনও বিষণ্ণ।
তাই মনে হচ্ছে? সামান্যতম মন খারাপ হয়নি কিশোরের।
মনে হচ্ছে মানে? অগাস্টের কণ্ঠে বিস্ময়।
ভেবেছিলাম, কিশোর বলল, রোলস রয়েসের দিকে নজর দেবে ওরা। ফাঁকি দিতে পারব। উল্টে আমাদেরকেই ফাঁকি দিয়ে দিল। ভাগ্যিস বুদ্ধিটা মাথায় এসেছিল।
হ্যাঁ, বেঁচে ফিরেছি বটে, কিন্তু পাথরটা গেল! মুসার গলায় তীব্র ক্ষোভ।
রবিন, কিশোর বলল, টর্চটা জ্বালো তো।
টর্চ জ্বালল রবিন, কিশোরের হাতে আলো ফেলেই স্থির হয়ে গেল।