ফোনেই বলেছি ওকে এখানে গাড়ি নিয়ে আসতে, জানাল কিশোর। এসো, একটা করে পুতুল তুলে নাও সবাই। চট করে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে তুলে ফেলো।
অন্ধকারে গা ঢেকে রয়েছে কালো রোলস রয়েস, কিন্তু তারার আলোর জন্যে পুরোপুরি লুকাতে পারছে না চকচকে শরীর।
মাস্টার কিশোর? ফিসফিস করে বলল হ্যাঁনসন, গাড়ি থেকে নেমে পড়ছে। দরজা খুলে দিয়েছি। পেছনের সিটে পুতুলগুলোকে তুলে দেয়া হলো; এমনভাবে, দেখলে মনে হবে চার কিশোর বসে আছে।
হ্যানসন, কিশোর নির্দেশ দিল, কোস্ট রোড ধরে দ্রুত চলে যাবেন। মোড় নিয়ে পাহাড়ের পথ ধরে এগিয়ে যাবেন একটানা দুঘণ্টা, তারপর আরেক দিক দিয়ে ঘুরে এসে এখানে ফেলে যাবেন ডামিগুলো। ঠিক আছে?
ঠিক আছে।
যান। গুডবাই। আপনার সঙ্গে হয়তো আর দেখা হবে না আমাদের। অনেক খারাপ ব্যবহার করেছি হয়তো, কিছু মনে রাখবেন। না।
আরে, না না, কী যে বলেন, হাঁ হাঁ করে উঠল ইংরেজ শশাফার। খারাপই লাগছে আমার। আপনাদের সঙ্গে কাজ করে অনেক মজা পেয়েছি। যাই, সুযোগ পেলেই দেখা করব।
যান। ও, হ্যাঁ, হেডলাইট জ্বালবেন না।
পুলিশ থাকলে? অগাস্ট প্রশ্ন করল।
ওপথে রাতে পুলিশ থাকে না, বিশেষ কোন ব্যাপার না ঘটলে।
চলে গেল রোলস রয়েস, প্রায় নিঃশব্দে, চুপিচুপি গা ঢাকা দিয়ে। পালাল যেন।
বাহ, চমৎকার! এতক্ষণে কথা বলল রবিন। কেউ চোখ রেখে থাকলে মনে করবে, আমরাই যাচ্ছি।
ভেবে চুপ করে বসে থাকবে না, কিশোর বলল। রোলস রয়েসের পিছু নেবে। চলো, এবার আমরাও যাই। লাল কুকুর চার দিয়ে বেরোতে হবে, বোরিস ওদিকেই পিকআপ নিয়ে বসে আছে।
ওয়ার্কশপে ঢুকে যন্ত্রটা নিয়ে এল কিশোর। লাল কুকুর চার দিয়ে বেরিয়ে এল অন্ধকার নির্জন পথে। পাহাড়ের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে। পিকআপ, প্রায় দেখাই যায় না, আগে থেকে না জানলে গাড়িটার গায়েই হুমড়ি খেয়ে পড়ত ওরা।
ছেলেরা চড়ে বসতেই গাড়ি ছেড়ে দিল বোরিস। পেছনে তাকিয়ে দেখল একবার কিশোর। না, কেউ অনুসরণ করছে বলে মনে হচ্ছে না।
নিরাপদেই পৌঁছল পিকআপ ডায়াল ক্যানিয়নে। হোরাশিও অগাস্টের ভাঙা বাড়ির কাছে এনে গাড়ি রাখল বোরিস। নীরব, নির্জন, কোথাও কোনরকম নড়াচড়ার আভাস নেই। লনে দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটা বড় ট্রাক আর বুলডোজার, যেন ভূত! প্রহরী নেই, রাখার কথা মনেই হয়নি বোধহয় কড়া সুপারভাইজারের।
বোরিস, চাপা কণ্ঠে নির্দেশ দিল কিশোর, ট্রাক ঘুরিয়ে রাস্তায় নিয়ে রাখুন। কড়া নজরে রাখবেন। কিছু দেখলেই দুবার হর্ন টিপবেন।
ঠিক আছে, বলল বোরিস।
যন্ত্রটা নামিয়ে নিল মুসা, তার হাত থেকে নিয়ে কাঁধে ফেলল কিশোর। এইবার দেখা যাক আমার ডিটেকটর ঈগলের সন্ধান পায়। কিনা।
কী বলছ, সহজ করেই বলো না, বাবা! দুহাত তুলল মুসা।
হাতে বেলচা নিয়ে পিকআপ থেকে লাফিয়ে নামল রবিন আর অগাস্ট।
এটা মেটাল ডিটেকটর, যন্ত্রটার লম্বা হাতলে চাপড় দিল কিশোর। ধাতব জিনিস মাটির কয়েক ফুট নিচে থাকলেও ঠিক ধরে ফেলবে, লনের দিকে হাঁটতে শুরু করল সে।
কিন্তু রক্তচক্ষু ধাতু নয়, রবিন প্রতিবাদ করল। পাথর।
সেটা আমিও জানি, চলতে চলতেই বলল কিশোর। দুপুরে জুতোর ফিতে বেধেছিলাম, মনে আছে? সেই সুযোগে রূপার একটা আধডলার গুঁজে দিয়েছিলাম মাটিতে। মুদ্রাটার এক পিঠে ঈগলের ছবি আছে না? ওই পাখিকেই এখন জিজ্ঞেস করব, পাথর আছে কোথায়।
কিন্তু, দুটো পনেরো মিনিটে মুদ্রা গুঁজেছ, সামনের অন্ধকারের দিকে চোখ মেলে বলল অগাস্ট। চিহ্ন কি ঠিক হবে?
সেজন্যেই একটু এগিয়ে গুঁজেছি, আড়াইটায় কোথায় ছায়া পড়বে। অনুমান করে নিয়ে। এই যে, এখানেই কোথাও হবে, কাধ থেকে যন্ত্র নামাল সে।
ডিটেকটরের চ্যাপ্টা গোল দিকটা মাটিতে রেখে হেডফোন পরে নিল কিশোর। তারপর হাতলের কাছের একটা সুইচ টিপে দিয়ে ধীরে ধীরে সামনে-পেছনে-আশপাশে সরাতে থাকল যন্ত্রটা। ধাতুর সন্ধান পেলেই গুঞ্জন উঠবে হেডফোনে, বলল সে।
কিন্তু অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও হলো না। ভারি যন্ত্র নাড়াচাড়া করে ক্লান্ত হয়ে গেল কিশোর। মুসার হাতে তুলে দিল।
মুসাও চেষ্টা করল বেশ কিছুক্ষণ। কিন্তু গুঞ্জন তুলতে যেন নারাজ হয়ে আছে হেডফোন। ঈগল পাখি উড়ে চলে গেছে! বলল সে একসময়। হতাশ। সারারাত খুঁজলেও পাব না!
কিন্তু এখানেই কোথাও থাকার কথা! ফিরে বাড়ির অন্ধকার ছায়াটার দিকে তাকাল কিশোর, অনুমান করে নিল আবার। এখানেই আছে। আরেকটা চক্কর দাও।
চক্কর পুরো করার দরকার হলো না, মৌমাছির গুঞ্জন উঠল হেডফোনে। লাফিয়ে উঠল মুসা, পেয়েছি! পেয়েছি!
চুপ! আস্তে! মুসার কান থেকে হেডফোন খুলে নিয়ে পরল কিশোর। হ্যাঁ, ঠিকই। আর সামান্য একটু পিছাও তো…আরেকটু পাশে…হ্যাঁ, হ্যাঁ, হয়েছে, হয়েছে, থামো!
হেডফোন খুলে কোমরের বেল্টে ঝোলানো টর্চ খুলল কিশোর। হাঁটু গেড়ে বসে আলো ফেলল মাটিতে, আঙুল দিয়ে খুঁচিয়ে বের করে তুলে নিল মুদ্রাটা। রবিন, গাস, খোঁড়ো এখানেই।
বেশ কিছুক্ষণ বেলচা চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ল রবিন আর অগাস্ট। মুসা আর কিশোরের হাতে তুলে দিল বেলচা। পালা করে মাটি খুঁড়ে চলল চার কিশোর। কিন্তু রক্তচক্ষুর দেখা নেই।
নীরব নিথর চারদিক, বেলচার থ্যাপ থ্যাপ ছাড়া কোন শব্দ নেই, এমনকী একটা ঝিঁঝিও ডাকছে না।