ডায়াল ক্যানিয়ন থেকে ফিরেই কিশোর সেই যে তার ওয়ার্কশপে ঢুকেছে, আর বেরোনোর নাম নেই। অন্য তিনজনের একজনকেও ঢুকতে দিল না। রক্তচক্ষু খোঁজার জন্যে কোন যন্ত্র বানাচ্ছে নাকি?
অবশেষে শেষ হলো দীর্ঘ বিকেল। তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে ফেলল। ছেলেরা, বোরিসকেও খেয়ে নিতে বলল কিশোর।
খেয়েদেয়ে পিকআপ বের করল বোরিস, ইয়ার্ড থেকে কয়েক ব্লক দূরে সহজে চোখে পড়ে না এমন একটা জায়গায় এনে গাড়ি থামিয়ে তাতে বসে রইল চুপচাপ।
ব্যাটাদের ধোকা দেয়ার জন্যে কিছু করতে হবে এবার, কিশোর বলল। হ্যানসনকে আসতে ফোন করে দিয়েছি, অন্ধকার নামলেই চলে। আসবে। আমাদের তৈরি থাকা দরকার।
এই শেষবার রোলস রয়েসে চড়া! আফসোস করল মুসা, তারপর থেকে পা সম্বল!
কেন, সাইকেল আছে না আমাদের? রবিন মনে করিয়ে দিল।
ওই তো, পা-ই তো সম্বল, মুসা বলল। ইঞ্জিন তো আর নেই, আরামও নেই। হাঁটার চেয়ে কম কষ্ট নাকি সাইকেল চালানো? পাহাড়ি পথে ওঠার সময় না বোঝা যায় ঠেলা! তিন গোয়েন্দার জারিজুরি শেষ।
এতদিন যে গাড়ি ছিল না, আমরা বসে থেকেছি নাকি? কিশোর বলল।কোন না কোনভাবে কাজ উদ্ধার হয়েই গেছে।
রোলস রয়েসের ব্যাপারে আগ্রহী মনে হলো অগাস্টকে, কী করে পাওয়া গেল ওটা, জানতে চাইল।
সংক্ষেপে জানাল মুসা। আক্ষেপ করল, এ-ই শেষবার, বুঝলে? আর পাব না। মানা করে দিয়েছে রেন্ট-আ-রাইড কোম্পানির ম্যানেজার। আরেকবার চাইতে গেলে গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে।
আরে, দূর, কী বকবক শুরু করেছ! ধমক লাগাল কিশোর। যখন ঠেকায় পড়ব তখন দেখা যাবে। চলো, তৈরি হয়ে নিই।
নিজের বেডরুমে তিনজনকে নিয়ে চলল গোয়েন্দাপ্রধান।
যেতে যেতে মুসাকে বলল অগাস্ট, একটা কথা কিন্তু ঠিক। ক্যালিফোর্নিয়া অনেক বড়, গাড়ি ছাড়া অসুবিধেই হবে তোমাদের।
ইয়ার্ডের পিকআপ আছে, বলল রবিন। ওটা ব্যবহার করতে পারছি।
পারছ, কিন্তু দেখছি তো, যতবারই দরকার পড়ছে, গিয়ে চাইতে হচ্ছে মেরি চাচীর কাছে। তখন বোরিসের হাতে কাজ আছে কিনা, সেটাও দেখতে হচ্ছে। অনেক ফ্যাকড়া না?
আলমারি খুলে চারটে জ্যাকেট বের করল কিশোর। সব কটাই তার, বিভিন্ন ধরনের, বিভিন্ন রঙের। একেকজনকে একেকটা দিয়ে পরতে বলল। অগাস্টের গায়ে মোটামুটি ঠিকই লাগল, রবিনের গায়ে সামান্য ঢলঢলে হলো, কিন্তু মুসার গায়ে লাগতেই চাইল না; জোরজার করে পরতে হলো, অন্যেরা সাহায্য না করলে পিঠের ওপর থেকেই নামাতে পারত না; চেন লাগাতে পারল না, সামনের দিক খোলা রইল জ্যাকেটের।
বেরিয়ে এল ওরা।
মেরি চাচী ওদেরকে দেখেই চোখ কপালে তুললেন। আরে, কী কাণ্ড! এই, কিশোর, এতই শীত লাগছে তোদের? একজনের জ্যাকেট আরেকজনে না পরলে চলছে না? কী জানি, বাপু, আজকালকার ছেলেছোকরাদের মতিগতি বুঝি না।
চাচাও হাঁটাহাঁটি করছেন বাইরে। ফিরে তাকালেন।
কয়েকটা লোককে ফাঁকি দিতে হবে, চাচী, সত্যি কথাটাই বলল কিশোর।
বাচ্চাদের খেলা! দাতে পাইপ, ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে ফকফক করে ধোয়া ছাড়ছেন রাশেদ পাশা। ছেলেবেলায় আমরাও ওরকম খেলেছি, কত। আহা, কী ছিল সেসব দিন! মামা-বাড়িতে যেতাম, শীতের সন্ধ্যায় কিষাণ বাড়িতে খড় পোড়াত, ধোঁয়া উঠত, গন্ধ এখনও যেন নাকে লেগে রয়েছে! চাঁদনী রাতে খেজুরের রস চুরি করতে যেতাম মামাতো ভাইদের সঙ্গে…যদি চিনে ফেলে কেউ? তাই মামার শার্ট-পাঞ্জাবি গায়ে চড়িয়ে ছদ্মবেশ নিতাম…ঢলঢল করত…আহ, বাচ্চা থাকাই ভাল। সোনালি দিনগুলো উড়ে চলে যায়…যেতে দাও, মেরি, ওদের আনন্দ মাটি কোরো না।
কিশোরের ওয়ার্কশপে চলে এল ছেলেরা। ছোট টেবিলে একটা জিনিস পড়ে আছে। একটা যন্ত্র, ভ্যাকুয়াম ক্লিনারের মত দেখতে, সরু দুটো তার বেরিয়ে এসেছে মূল অংশ থেকে, তারের মাথায় হেডফোন লাগানো। বোঝা গেল, সারা বিকেল এটা নিয়েই খেটেছে কিশোর।
এক কোণে চারটে বড় পুতুল, ওই যে, দরজিদের পোশাক তৈরি করার ডামি, যেগুলো কিনে এনেছিলেন রাশেদ চাচা, মুশূন্য চারটে ধড়। নিচের স্ট্যাণ্ড কেটে ফেলে দিয়েছে কিশোর।
এসো, হাত লাগাও, ডাকল সে। এগুলোকে পোশাক পরাতে হবে। কেন জ্যাকেটগুলো পরে এসেছি, বুঝেছ তো? দূরবীন নিয়ে কেউ ইয়ার্ডের ওপর চোখ রেখেছে কিনা জানি না। রাখতে পারে। হাতে করে আলাদা কাপড় আনলে ওরা সন্দেহ করে বসত। জ্যাকেট খোলো, পুতুলগুলোকে পরাও।
জ্যাকেট পরে হাস্যকর রূপ নিল দরজির ডামি। হাত নেই, দুপাশে ঝুলছে জ্যাকেটের হাতা।
ভূত মনে হচ্ছে, মুসা মন্তব্য করল। এই জিনিস দেখিয়ে ফাঁকি। দিতে চাও?
মাথা লাগালেই অনেক জ্যান্ত মনে হবে, কিশোর আশ্বাস দিল।
টেবিলের ড্রয়ার থেকে চারটে বেলুন বের করল সে। ফুঁ দিয়ে ফোলাল। তারপর সুতো দিয়ে বাধল কাটা গলার সঙ্গে। এদিক দুলছে, ওদিক দুলছে বেলুন; মনে হচ্ছে যেন মাথা নাড়ছে পুতুল।
হা হা করে হেসে উঠল মুসা। রবিন আর অগাস্টও হাসল।
অন্ধকারে জ্যান্তই মনে হবে, এপাশ থেকে, ওপাশ থেকে দেখে আবার বলল কিশোর।
অপেক্ষা করছে ওরা। ধীরে ধীরে নামল অন্ধকার। পুতুলগুলোকে এখন আর হাস্যকর লাগছে না, হঠাৎ কেউ দেখলে বরং ভয়ই পেয়ে যাবে।
ইয়ার্ডের চত্বরে গাড়ির বাঁশি শোনা গেল।
হ্যানসন, কিশোর বলল।
খানিক পরেই ইঞ্জিনের মৃদু শব্দ এসে থামল ওয়ার্কশপের বেড়ার বাইরে।