আর এক ঘণ্টাও তো নেই! ঘড়ি দেখে বলে উঠল মুসা।
দূরও আর বেশি নেই, কিশোর বলল। এসে গেছি প্রায়।
কী ভেবে পেছনে তাকাল মুসা। রাস্তা শূন্য। একটা গাড়িও দেখা যাচ্ছে না, অনুসরণ করছে না কেউ।
আগেই দেখেছি, কেউ পিছু নেয়নি আমাদের। আর নিলে নিল। বোরিস আর রোভারের হাতের কিছু কিলঘুসি প্রাপ্যই হয়েছে ওদের।
হঠাৎ মোড় নিয়ে পাশের সরু পথে নেমে এল পিকআপ। দুপাশে পাহাড়। কতদিন আগে পথ বাঁধানো হয়েছিল, কে জানে, তারপর আর মেরামত করা হয়নি, নষ্ট হয়ে গেছে জায়গায় জায়গায়, ছালচামড়া আর মাংস উঠে গেছে পথের, ছোট ছোট গর্তে পড়ে বিষম ঝাঁকুনি খাচ্ছে গাড়ি, ঝনঝন আর্তনাদ তুলছে পুরানো বডি।
কিশোর, পেছনে নেই, ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে আছে মুসা। কিন্তু সামনে আছে!
দুপাশে দুজন করে এসে ঝুঁকে দাঁড়াল, দৃষ্টি সামনে। পথ জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে গোটা কয়েক বিশাল ট্রাক, বুলডোজার, আর ইঞ্জিনে চলে এমন একটা দানবীয় বেলচা।
মিস্টার হোরাশিওর বাড়ির খানিকটা মস্ত চোয়ালে চেপে ধরে ছিঁড়ে নিয়ে এসেছে বেলচাটা, একটা ট্রাকে নামিয়ে দিয়ে চোয়াল ফাঁক করে
আবার এগিয়ে যাচ্ছে আরেক লোকমা তুলে আনার জন্যে। বাড়ির ছাত। আর একটা ধার ইতিমধ্যেই ধ্বংস করে দিয়েছে যন্ত্রটা, বাকিটুকুও খতম করে দেবে দেখতে দেখতে। যেন একটা মহারাক্ষস।
বাড়ির পেছনের গাছপালা টিলাটব্ধর যা আছে, সমান করে দিচ্ছে বুলডোজার। দ্রুত নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে হোরাশিওর অতি শখের বাগান।
দানবের দল! চিকচিক করছে অগাস্টের দুচোখের কোণ। ইস, কী করছে! দাদা এখন থাকলে… গলা ধরে এল তার।
সমান করে ফেলছে সব! গুঙিয়ে উঠল রবিন। রক্তচক্ষু আর আগের জায়গায় আছে কিনা, কে জানে!
মনে হয় আছে, ভুরু কুঁচকে লনের দিকে তাকিয়ে আছে অগাস্ট। দেখছ, ওই যে পাহাড়ের ছায়া, ওদিকে কেউ নেই।
রাবিশ, নিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল একটা ট্রাক। মুখ বের করে ড্রাইভার হাকল, এই, সরো, পথ ছাড়া। আমাদের তাড়া আছে।
পিকআপকে রাস্তার এক পাশে সরিয়ে রাখল বোরিস, পাশ কেটে চলে গেল ট্রাকটা। আরও ট্রাক এসে পড়েছে রাবিশের বোঝা নিয়ে। ওটাও চলে গেল।
খোলা জায়গায় নিয়ে যান, লনের দিকে দেখিয়ে বোরিসকে বলল কিশোর। কেউ কিছু বললে আমি জবাব দেব।
হোকে, বলে আবার পিকআপ রাস্তায় তুলল বোরিস, শদুই গজ এগিয়ে লনের কাছে এসে থামল।
লাফিয়ে গাড়ি থেকে নামল ছেলেরা।
ওদেরকে দেখে ভাঙা বাড়ির দিক থেকে এগিয়ে এল একজন বেঁটে খাটো লোক, মাথায় ধাতব হেলমেট, সুপারভাইজার বোধহয়।
এখানে কী করছ? কড়া গলায় জিজ্ঞেস করল লোকটা। বাইরের লোক আসা নিষেধ।
ভাবভঙ্গি দেখেই ভড়কে গেল মুসা আর রবিন। কী জবাব দেবে। কিশোর?।
কিন্তু জবাব তৈরিই রয়েছে গোয়েন্দাপ্রধানের মুখে। আমার চাচা পুরানো জিনিসপত্র কিনেছিল এখান থেকে। কিছু ফেলে গেল কিনা দেখতে পাঠিয়েছে।
কিছু নেই। সামান্যতম নরম হলো না লোকটা। একটা সুচও না। যাও।
আচ্ছা, কয়েক মিনিট দাঁড়াতে পারি আমরা? সুর পাল্টাল কিশোর। এই যে, আমার বন্ধু, অগাস্টকে দেখাল সে। ইংল্যাণ্ড থেকে এসেছে। আমেরিকায় কী করে বাড়িঘর ভাঙা হয়, দেখেনি কখনও। ওর নাকি খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।
শুনেছ, কী বলেছি তোমাকে? ধমকে উঠল লোকটা। এখানে সারকাস চলছে না, দেখার কিছু নেই। গায়ে এসে যখন কিছু পড়বে,
তখন বুঝবে ঠেলা। ব্যথা পাবে, ঝামেলা বাধাবে খামোকা।
এই… চট করে ঘড়ির দিকে তাকাল কিশোর। সওয়া দুটো বাজে, এই, পনেরো মিনিট? অনুরোধ করল সে। পনেরো মিনিট পরেই চলে যাব।
পনেরো সেকেণ্ডও না! ভীষণ একরোখা লোক। যাও, ভাগো!
লনে এসে পড়া ছায়ার দিকে তাকাল ছেলেরা। পনেরো মিনিট পরেই পাহাড়ের চূড়ার ছায়া পড়বে রক্তচক্ষু যেখানে আছে, সেখানে।
ঠিক আছে, স্যর, যাচ্ছি, কিশোরও নাছোড়বান্দা। কিন্তু, স্যর, দুএকটা ছবি তুলতে তো কোন আপত্তি নেই?
জবাবের অপেক্ষা করল না কিশোর। কাঁধে ঝোলানো ক্যামেরা নামিয়ে নিয়ে পা বাড়াল ছায়ার দিকে। চিৎকার করার জন্যে মুখ খুলেই থেমে গেল সুপারভাইজার, বোধহয় ভাবল ওদিকে গেলে দুর্ঘটনার সম্ভাবনা নেই।
ছায়ার মাথা থেকে গজখানেক দূরে এসে দাঁড়িয়ে গেল কিশোর, ফিরে ভাঙা বাড়িটার ছবি তুলল একটা। ক্যামেরা আবার কাঁধে ঝুলিয়ে নিচু হয়ে জুতোর ফিতে বাধল সময় নিয়ে। ফিরে এল।
থ্যাঙ্ক ইউ, স্যর, বলল কিশোর। যাচ্ছি।
আর যেন না দেখি এখানে! বেশি খারাপ ব্যবহার করে ফেলেছে ভাবল হয়তো লোকটা, তাই বলল, তবে, মাস তিনেক পরে এলে আর কিছু বলব না। ছটা বাড়ি আর বড় সুইমিং পুল বানিয়ে ফেলব ততদিনে, চাইলে একটা বাড়িও কিনতে পারো। ছোট্ট একটা হাসি দিল সে।
পিকআপে এসে উঠল কিশোর। তার পিছনে এল বিষণ্ণ তিন কিশোর।
স্টার্ট নিয়ে গাড়ি চলতে শুরু করতেই ক্ষোভ ঝাড়ল মুসা, এক্কেবারে ছোটলোক, ব্যাটা! পনেরোটা মিনিটও থাকতে দিল না। লাঠি দিয়ে কুত্তা, খেদাল যেন! গেল গাসের রক্তচক্ষু! কাল এসে লনের চিহ্নও দেখব না!
কাল আসতে যাচ্ছে কে? ভুরু নাচাল কিশোর। আজ রাতেই আসব।
অন্ধকারে? হাঁ হয়ে গেছে রবিন। অন্ধকারে কী দেখব? ছায়া-টায়া। কিছু থাকবে না তখন!
ঈগল পাখিকে বলব জায়গাটা খুঁজে দিতে, মুচকি হাসল কিশোর। ব্যস, এই পর্যন্তই, আর একটাও কথা বের করা গেল না তার মুখ থেকে।
ষোলো
ক্লান্ত শামুকের মত যেন গড়িয়ে চলল সময়। এক বিকেল পার করতেই ছেলেদের মনে হলো কয়েকশো যুগ পার হচ্ছে। সময় কাটানোর জন্যে কত কী-ই যে করল ওরা: বোরিস আর রোভারকে কাজে সাহায্য করল, মেরি চাচী দশবার বলেও যে কাজে হাত দেয়াতে পারেননি ছেলেদেরকে, আর কিছু না পেয়ে শেষে তেমন কাজও করল ওরা। চাই কী, অনেক পুরানো কয়েকটা লোহার চেয়ারের মরচে তুলল মুসা সিরিশ দিয়ে ঘষে, তারপর ব্রাশ নিয়ে রঙ করায় মন দিল। কিশোর এসবের মধ্যে নেই।