জানি, স্যর, নরম হয়ে বলল কিশোর। আর খুব নিখুঁতভাবে গোেনার চেষ্টা করি। পকেট থেকে নোটবুক বের করে তার ভেতর থেকে বের করল একটা খাম। খাম থেকে ছোট একটা ভাঁজ করা খবরের কাগজের টুকরো বের করে মেলল। জোরে জোরে পড়ল, রাজকীয় রোলস রয়েস ব্যবহারের সুবর্ণ সুযোগ! শোফারসহ অন্যান্য সব খরচ-খরচা কোম্পানির। তিরিশ দিন চব্বিশ ঘণ্টা করে ব্যবহার করা যাবে গাড়িটা, যদি ছোট্ট একটা কাজ করতে পারেন। জারে কটা শিমের বীচি আছে আন্দাজ করে বলতে হবে। রেন্ট-আ-রাইড অটো রেন্টাল কোম্পানি।
ভুরু নাচাল ম্যানেজার। ঠিকই তো আছে। কথার বরখেলাপ করেছি আমরা? তিরিশ দিনের জন্যে গাড়িটা দেয়া হয়েছে তোমাকে; যখন ডেকেছ, পেয়েছ। দিনে-রাতে যখন খুশি।
লেখাটা আরেকবার ভাল করে দেখলে ভাল হত না, স্যর? অনুরোধ করল কিশোর। লেখা হয়েছে, তিরিশ দিন চব্বিশ ঘণ্টা করে ব্যবহার করা যাবে।
গোলমালটা কোথায় দেখলে? রেগে যাচ্ছে ম্যানেজার। চব্বিশ ঘণ্টায় দিন, এটা তো সবাই জানে।
ঠিক বলেছেন, সঙ্গে সঙ্গে কথা ধরল কিশোর। যেটা সবাই জানে, সেটা ঢাকঢোল পিটিয়ে বলার দরকার কী? উল্লেখ করার কোন দরকার ছিল? বললেই চলত, তিরিশ দিনের জন্যে গাড়িটা পাওয়া যাবে।
ইয়ে…মানে… তোতলাতে শুরু করল ম্যানেজার, একটু যেন। ঘাবড়ে গেছে। মানে, আমি পরিষ্কার করে সব বলতে চেয়েছিলাম।
তা চেয়েছেন, মাথা ঝাঁকাল কিশোর। কিন্তু আমার কাছে। অন্যরকম লাগছে। আমি ধরে নিচ্ছি চব্বিশ ঘণ্টা করে তিরিশ দিন, তার মানে তিরিশ গুণন চব্বিশ। এখন আমার হিসেবে, আবার নোটবই খুলল। সে, আমি গাড়িটা ব্যবহার করেছি মোট সাতাত্তর ঘণ্টা পঁয়তাল্লিশ মিনিট, মানে তিন দিনের কিছু বেশি। তা হলে, আরও প্রায় সাতাশ দিন থেকে যাচ্ছে।
হাঁ হয়ে গেছে মুসা আর রবিন। কিশোরের কথা উড়িয়ে দেয়ার উপায় নেই। অযৌক্তিক কিছু বলছে না সে।
কথা হারিয়ে ফেলেছে ম্যানেজার। রাগে লাল চেহারা আরও লাল হয়ে উঠেছে।
অসম্ভব! হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠল সে। ওরকম কিছু বলিনি আমি! ওটা একটা কথা হলো নাকি?
সেজন্যেই তো, স্যর, শান্ত রয়েছে কিশোর, যা বোঝানো দরকার ঠিক তা-ই বলা উচিত। কথা বড় খারাপ জিনিস, একটু এদিক-ওদিক হলেই…। এই যে, দেখুন না, এখানে আপনি বোঝাতে চেয়েছেন…
না, আমি চাইনি! গর্জে উঠল ম্যানেজার। আমার সবচেয়ে ভাল গাড়িটা তোমাকে সারাজীবনের জন্যে দিয়ে দেব ভাবহু! বিজ্ঞাপনে কী লেখা আছে না আছে, কেয়ার করি না আমি। তিরিশ দিন বলেছি, তিরিশ দিনের জন্যে দিয়েছি। সময়সীমা শেষ। যাও।
কিন্তু আমরা তো ছিলামই না রকি বিচে, প্রতিবাদ করল এবার রবিন। তিরিশ দিন কী করে ব্যবহার করলাম? কোনরকম ফাঁক না দিয়ে তিরিশ দিন ব্যবহার করতে হবে, এটাও তো লেখেননি। এ-ও তো ধরে নিতে পারি, বছরে একদিন করে আগামী তিরিশ বছর পাব আমরা গাড়িটা। নাকি?
এই নতুন আঘাতে থতমত খেয়ে গেল ম্যানেজার। না…তা…! মাথা কাত করল সে। আচ্ছা, ঠিক আছে, আমি একটা প্রস্তাব দিচ্ছি। আর দুবার গাড়িটা পাবে তোমরা। তবে কথা দিতে হবে, এরপর আর কখনও জ্বালাতে আসবে না। দুবার, ঠিক আছে?
জোরে নিঃশ্বাস ফেলল কিশোর। খুব নিরাশ হয়েছে যেন। ঠিক আছে, কী আর করা! আপনাদের গাড়ি, জোর করে তো আর নিতে পারব না। রাজি, দুবারেই রাজি। রবিন, চলো, যাই। ম্যানেজারের দিকে ফিরল। আবার সে। কাল সকাল সাড়ে নটায় চাই একবার। পাওয়া যাবে?
যাবে। যাও।
চুপচাপ বেরিয়ে ফোঁসস করে শ্বাস ফেলল মুসা। রাজি হলে কেন? ব্যাটা আটকে গিয়েছিল, চাপ দিলেই কাজ হয়ে যেত।
না-ও হতে পারত, কিশোর বলল। হয়তো কোর্টে নালিশ করতে বলত আমাদেরকে। বিচারে ঠকে যেতাম আমরা। তিরিশ দিন চব্বিশ ঘণ্টা করে ওই তিরিশ দিনকেই বোঝায়।
কিন্তু মাত্র দুবার ব্যবহার করলেই বা কী, আর না করলেই বা কী?
তাই বা কম কীসে? গাড়িটা তো আর আমাদের সম্পত্তি না। সুর করে বলে উঠল কিশোর, সামনে যা পাও হাত পেতে নাও, বাকির খাতা শূন্য থাক। চরণ দুটো ইংরেজিতে আবার অনুবাদ করে বলল সে।
তার মানে যা পেলাম, তাই নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে বলছ? মুসা বলল। হ্যাঁ। কে জানে, নতুন কোন উপায় বেরিয়েও যেতে পারে। হয়তো আরও অনেক দিন অনেক বার গাড়িটা ব্যবহারের সুযোগ পেয়েও যেতে পারি আমরা। আগামীকাল মিস্টার ক্রিস্টোফারের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছি, প্যাসিফিক স্টুডিওতে পুরানো পিকআপ নিয়ে যেতে হচ্ছে না, এতেই খুশি আমি। ভাবছি, কী রহস্য ওখানে অপেক্ষা করছে আমাদের জন্যে!
তিন
এসো, এসো, তিন গোয়েন্দাকে দেখেই ডাকলেন মিস্টার ক্রিস্টোফার। পরিচয় করিয়ে দিই। বিশাল টেবিলের ধারে চেয়ারে বসা এক কিশোরকে দেখালেন তিনি। ও অগাস্ট অগাস্ট, ব্রিটিশ। অগাস্ট, এই আমাদের তিন গোয়েন্দা। ও কিশোর পাশা, বাড়ি বাংলাদেশ। ও মুসা আমান, আদিবাস ছিল আফ্রিকায়, এখন আমেরিকার নাগরিক। আর এ হলো রবিন মিলফোর্ড, এ-ও খাঁটি আমেরিকান নয়, আইরিশ রক্ত রয়েছে, তার মানে তোমার আর আমার বাড়ির কাছের লোক।
এক এক করে চেয়ার টেনে বসল তিন গোয়েন্দা। উঠে এসে হাত বাড়িয়ে দিল ইংরেজ কিশোর। লম্বা তাল পাতার সেপাই, পাতলা চুল খুব লম্বা করে রেখেছে। চোখা উঁচু নাকের ঠিক মাঝখানে বসে আছে। হরিমড গ্লাসের চশমা। তোমাদেরকে পেয়ে খুব খুশি হয়েছি। একে একে হাত মেলাল তার সমবয়েসী তিন কিশোরের সঙ্গে। বন্ধুরা আমাকে গাস বলে ডাকে, অগাস্টের সংক্ষেপ আরকী, তোমরাও তাই ডাকবে।