ধৈর্য ধরো। উপায় ভাবছি আমি।
জলদি করো, কিশোর! হুটোপুটি শুনছি, ইঁদুর আছে মনে হয়!
চিমটি কাটতে পারছে না, নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরেই গভীর ভাবনায় ডুবে গেল কিশোর। একটা কোন উপায়! একটা! চেয়ারে নড়েচড়ে উঠল সে, তার চেয়ে বেশি নড়ল চেয়ারটা, বিচিত্র শব্দ করে প্রতিবাদ জানাল যেন।
রান্নাঘরের জানালা দিয়ে দেখতে পাচ্ছে কিশোর, বাইরে সময় যেন ছুট লাগিয়েছে। একটা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে আছে মনে হচ্ছে। পশ্চিমের উঁচু চূড়ার ছায়া এসে পড়েছে লনে, সূর্য যতই দিগন্তে নামছে, ততই বাড়ছে ছায়াটা।
টেনেটুনে আরেকবার হাতের বাঁধন পরীক্ষা করল কিশোর। কচমচ, মড়মড় করে উঠল আবার চেয়ার। বিদ্যুৎ ঝিলিক হানল যেন তার মগজে। মনে পড়ল, কিছুদিন আগে পুরানো নড়বড়ে একটা চেয়ারে বসে। পড়েছিল সে, মড়াৎ করে ভেঙে প্রায় বসে গিয়েছিল চেয়ারটা।
শরীরটা সামনে-পেছনে করতে শুরু করল, কিশোর, চেয়ারও নড়ছে। তার সঙ্গে। জোড়াগুলো খুলবে খুলবে করছে, কিন্তু খুলছে না। ঝটকা। মেরে, এক পাশে কাত হয়ে গেল কিশোর, চেয়ার নিয়ে পড়ল ভ্রাম করে। চেয়ারের একটা পায়া ছুটে গেল। কয়েকবার জোরে জোরে পা ছুঁড়তেই খুলে উড়ে চলে গেল পায়াটা, কিশোরের পায়ে দড়ির প্যাঁচগুলো ঢলঢলে হয়ে গেল। যাক, ডান পা-টা মুক্তি পেল!
অন্য পা মুক্ত করার চেষ্টায় লাগল কিশোর। টানাহেঁচড়া করে লাভ হলো না। শেষে ডান পায়ে ভর দিয়ে উঠে তিন পায়ার ওপর বসাল। চেয়ারটাকে ধাক্কা দিয়ে কাত হয়ে চেয়ার নিয়ে পড়ল আরেক পাশে। মড়াৎ করে বাঁ হাতটা ভাঙল চেয়ারের। নিজেও ব্যথা পেয়েছে কিশোর, গুঙিয়ে উঠল। কিন্তু চুপ করল না। হ্যাঁচকা টান মারল বা হাতে, জোড়া থেকে খুলে এল চেয়ারের বা হাতা। হাতটা বার বার ঝাঁকি দিয়ে হাতা খুলে ফেলার চেষ্টা করল।
কিশোর! মুসার উদ্বিগ্ন ডাক শোনা গেল। কী হয়েছে? মারপিট করছ?
হ্যাঁ, চেয়ারের সঙ্গে, জবাব দিল, কিশোর। আমি জিতছি। আর মিনিট দুই অপেক্ষা করো।
উঠে আবার চেয়ার নিয়ে কাত হয়ে পড়ল কিশোর, মড়মড় করে উঠল চেয়ার, বেঁকাতেড়া হয়ে গেল, কিন্তু আর কোন জোড়া খুলল না। অনেক কায়দা-কসরৎ করেও বাঁ হাত থেকে চেয়ারের হাতা খসাতে পারল না সে। চেষ্টা করে দেখল, হামাগুড়ি দেয়া যায়, শেষে হামাগুড়ি দিয়েই এগোল জানালার দিকে ছুরিটার জন্যে।
দুই হাতেরই কব্জি অবধি বাধা, আঙুলগুলো নড়ানো যায়। জানালার চৌকাঠ থেকে বাঁ হাতে ছুরিটা তুলে নিতে পারল কিশোর। ব্যস, হয়ে গেছে কাজ! বাঁধন কেটে মুক্ত হতে আর মাত্র এক মিনিট লাগল।
প্রচণ্ড পরিশ্রম গেছে, মেঝেতেই চিত হয়ে শুয়ে জিরিয়ে নিল কিশোর। ডেকে বলল, মুসা, আমি আসছি।
আল্লাহ! অনেকক্ষণ অন্ধকারে থেকে আলোয় এসে চোখ মেলতে পারছে না মুসা। দড়ি খুললে কী করে?
মগজের ধূসর কোষগুলোকে ব্যবহার করে, মাথায় টোকা দিল কিশোর। চলো, জলদি কাটি এখান থেকে। কোন কারণে কালো গুফোদের কেউ আবার এসে পড়লেই গেছি। রবিনের খবর শোনো, অকটেভিয়ানকে খুঁজে পেয়েছে…
তাই নাকি? চেঁচিয়ে উঠল মুসা।
ভাল খবর! যোগ করল অগাস্ট।
কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই হারিয়েছে আবার, আগের বাক্যটা শেষ করল কিশোর। কালো-ফোরা নিয়ে গেছে। চলো, যেতে যেতে বলব।
সাইকেলগুলো তেমনি পড়ে আছে। তুলে নিয়ে চড়ে বসল তিনজনে, দ্রুত ফিরে চলল রকি বিচে। যাওয়ার পথে সব খুলে বলল কিশোর।
ইশশ, বার বার এসেও আবার চলে যাচ্ছে আমাদের নাকের ডগা দিয়ে! বিলাপ করে উঠল যেন মুসা। মূর্তিটায় জিনের আসর হয়েছে।
বোধহয় অভিশাপই কাটেনি এখনও, মন্তব্য করল অগাস্ট।
না কাটলে আমাদের কী? কালো-গুফোরা মরবে, কিশোর বলল। আমি অবাক হচ্ছি জিকোর কথা ভেবে। তিন-ফোঁটা বলল ওকে মেরে ফেলেছে, তা হলে আবার এল কোত্থেকে?
হুঁ, রহস্যই! মুসা ঘাড় দোলাল। কিন্তু ওসব ভাবনা তো পরে, আবার অকটেভিয়ানকে পাচ্ছি কী করে? গাস, তোমার সম্পত্তি বোধহয় গেল।
তিনজনেই চিন্তিত। কথা জমল না। চুপচাপ সাইকেল চালিয়ে রকি বিচে এসে পৌঁছল। সূর্য অস্ত যাচ্ছে, ইয়ার্ডের গেটে ঢুকে মনে পড়ল ওদের, সারাদিন কিছু খায়নি, মনে পড়তেই মোচড় দিয়ে উঠল পেটের ভেতর।
রবিন, বোরিস আর রোভার, তিনজনেই কাজে ব্যস্ত। চাচা-চাচীকে দেখা যাচ্ছে না। ইয়ার্ডের শেষ মাথায় বড় বড় গাছের গুঁড়ি একটার ওপর আরেকটা তুলে রাখছে দুই ব্যাভারিয়ান। পিকআপটা দাঁড়িয়ে আছে। অফিসের কাছে। কয়েকটা লোহার চেয়ারে রঙ করছে রবিন।
মন খারাপ নরি, বলল মুসা। দেখেছ, ব্যাজার হয়ে আছে?
আমাদেরও তো তাই, কিশোর বলল।
সাইকেলের শব্দ শুনে মুখ তুলল রবিন। জোর করে হাসার চেষ্টা করল। এই যে, এসেছ। ভেবেই মরছিলাম, কোথায় গেছ!
গাসের দাদার বাড়িতে, সাইকেলটা স্ট্যাণ্ডে তুলতে তুলতে বলল। কিশোর। তোমার কী খবর?
ইয়ে… বলতে গিয়েও থেমে গেল রবিন, এতবড় একটা দুঃসংবাদ শোনাতে বাধছে।
ঠিক আছে, বলতে হবে না, কণ্ঠে রহস্য ঢালল কিশোর। এদিকে এসো।…আমার চোখে চোখে তাকাও। হ্যাঁ, না না, পাতা বন্ধ কোরো না। তোমার চোখ দেখেই বলে দিতে পারব মনে কী আছে।
মিটিমিটি হাসছে মুসা আর অগাস্ট।
রবিনের চোখে কিশোরের দৃষ্টি স্থির, আস্তে আস্তে টোকা দিচ্ছে নিজের কপালে। হ্যাঁ, আসছে…পড়তে পারছি-ফোন এসেছিল, এক ভূত ফোন করেছিল। অকটেভিয়ানের খোঁজ মিলেছে। পিকআপ আর বোরিসকে নিয়ে ছুটলে। তারপর…তারপর, মূর্তিটা পেলে, গাড়িতে তুললে! হলিউডের এক বাড়িতে পেয়েছ, ঠিক হচ্ছে না?